মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল কাসাভা

আপডেট : ২০ মে ২০২১, ০২:১৩ এএম

কাসাভা এক ধরনের শেকড়জাত আলু, যা সাধারণত পাহাড়ি অনাবাদি ও অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমিতে চাষ করা হয়। এটি উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের কন্দজাতীয় ফসল। গাছটির পাতা দেখতে অনেকটা শিমুলগাছের পাতার মতো হওয়ায় এ দেশে এটি শিমুল আলু নামে সমধিক পরিচিত। রোগজীবাণু ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধী এ ফসলটি সহজেই অনুর্বর ও খরাপ্রবণ এলাকায় চাষ করা যায়। পৃথিবীর ৯০টির বেশি দেশে কাসাভা উৎপাদিত হয়। বিশে^ উৎপাদিত স্টার্চের শতকরা ৮০ ভাগ উৎপাদিত হয় কাসাভা থেকে। কাসাভায় সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ভাগ শর্করা, ১ থেকে ২ ভাগ প্রোটিন এবং ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ জলীয় অংশ থাকে। আলুর তুলনায় কাসাভায় দ্বিগুণের বেশি শর্করা থাকায় এটি আলুর চেয়েও বেশি পুষ্টিকর। যেখানে আলুয় শর্করার মাত্র শতকরা ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসেবে থাকে, সেখানে কাসাভায় শতকরা ৪০ ভাগ শর্করায় ৯০ ভাগই স্টার্চ হিসেবে থাকে। এ ছাড়া কাসাভায় ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কাসাভার বিদ্যমান ফাইবার দৈহিক ওজন ও দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিস এবং স্থূলতা বা মেদ তৈরির বিরুদ্ধে কাজ করে।

কাসাভা থেকে উন্নত মানের স্টার্চ পাওয়া যায়। ওই স্টার্চ দিয়ে গ্লুকোজ, বার্লি, সুজি, রুটি, নুডলস, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পাঁপড়, চিপসসহ নানা ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। বস্ত্র ও ওষুধশিল্পে ব্যাপকভাবে কাসাভা স্টার্চ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া কাসাভা সেদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে কিংবা পাউডার করে আটা হিসেবেও খাওয়া যায়। কাসাভার পরিষ্কার কন্দ সরাসরি কাঁচা অবস্থায়ও খাওয়া যায়। পাশাপাশি এই স্টার্চ দিয়ে পশুখাদ্যও তৈরি করা যায়।

কাসাভার অনেকগুলো প্রচলিত ও উন্নত জাত রয়েছে। কৃষকরা খাবার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে জাত নির্বাচন করে থাকেন। খাবারের জন্য অনেক কৃষক মিষ্টিজাতের কাসাভা রোপণ করেন।

উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল কাসাভা চাষের জন্য উপযোগী। তবে এ ফসলটি জলাবদ্ধতা ও উচ্চ লবণাক্ততা মোটেই সহ্য করতে পারে না। এটি একটি খরা সহনশীল ফসল। যেখানে ছয় মাস পর্যন্ত খরা বা শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে সেখানেও কাসাভা চাষ করা যায়। তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে কাসাভা ভালো হয় না। কাসাভা চাষের উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা বছরই কাসাভার চাষ করা যায়। তবে সাধারণত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো। আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে মে মাস হলো কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য পরিপক্ব কাণ্ডের কাটিং ব্যবহার করা হয়। কাসাভা সংগ্রহের সময় সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত কাণ্ডগুলো কেটে পরবর্তী বছরের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করা হয়। কাণ্ডকে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা করে কেটে সোজা করে লাগাতে হবে। প্রতিটি কাটিংয়ে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭টি পর্ব (নোড) থাকতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গর্ত বা পিট তৈরি করে কাসাভার কাটিং রোপণ করা হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে কাসাভা চাষের জন্য ১০ হাজার কাটিংয়ের প্রয়োজন হয়। একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব দিতে হয় ৭৫ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার। কাটিং মাটির ২০ সেন্টিমিটার নিচে এবং ৫ সেন্টিমিটার ওপরে লাগাতে হয়।

দেশে কাসাভা চাষ হয় এমন জেলাগুলো হলো রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাসাভা চাষে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার চাষির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির ভিত্তিতে কৃষকদের কাসাভা চাষে উৎসাহ দিয়ে আসছে। এর ফলে দেশে অব্যবহৃত পাহাড়ি জমির ব্যবহার বাড়ছে। উন্নত হচ্ছে পরিবেশ। কৃষি উপকরণ, স্বল্পমূল্যে বীজ এবং কৃষক প্রশিক্ষণ দিয়ে কাসাভা চাষে সহায়তা করছে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত কাসাভা সংগ্রহ ও রোপণের কাজ একসঙ্গে চলতে থাকে। কৃষকরা পরিপক্ব কাসাভা ফসল তোলার পর আবার নতুন করে কাটিং রোপণ করেন। দেশে হেক্টরপ্রতি কাসাভার ফলন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় কৃষকরা এই ফসলটির চাষে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

হবিগঞ্জে শিল্পপার্কে একটি কাসাভা প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে। এতে প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার টন কাসাভা প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। সরকার কন্দজাতীয় ফসলের উন্নয়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যাতে পাহাড়ি অনাবাদি কিংবা কম উর্বর জমিতে কাসাভার চাষ বৃদ্ধি করা যায়। সরকারের এই উদ্যোগ কাসাভার চাষ সম্প্রসারণে বড় ভূমিকা রাখছে। তবে এই ফসল নিয়ে পাহাড়ি ও অনুর্বর এলাকায় কৃষকদের মধ্যে আরও প্রচারণা প্রয়োজন, যাতে বাড়ির আশপাশের অনাবাদি জমিতে কাসাভার আবাদ বাড়ানো যায়।

২০২০ মৌসুমে চুক্তিবদ্ধ কৃষকের চাষ করা ৪ হাজার ৭৫০ একর জমি থেকে ১৯ হাজার টন কাসাভা সংগ্রহ করে প্রাণ। এর আগের বছর ৫ হাজার ১৪০ একর জমি থেকে ১৩ হাজার ১৯১ টন কাসাভা সংগ্রহ করা হয়। প্রাণের কোনো কোনো চুক্তিবদ্ধ কৃষক একরে সর্বোচ্চ ৯ টন কাসাভা উৎপাদন করেন। বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলায় সবচেয়ে বেশি কাসাভা উৎপাদন হয় এবং তুলনামূলক সিলেট জেলায় প্রতি বছরই বাড়ছে সম্ভাবনাময় নতুন ফসলটির উৎপাদন। কৃষক প্রতি টন কাসাভা ৭ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এতে কৃষক আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হন। শ্রীমঙ্গলে কালাপুর ইউনিয়নের মাজডিহি গ্রামের হুদার পাড়ে ৬০ একর টিলার জমি ইজারা নিয়ে ২০১৯ মৌসুমে কাসাভা চাষ করেন রাজিব কুমার রায়। তার ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকার মতো। সব খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা। প্রতি একর জমি থেকে ৬ মাসে ৪ টন কাসাভা উৎপাদন করা যায় অনায়াসে। ৪ টন কাসাভার বিক্রয়মূল্য ৩০ হাজার টাকা। এক একর জমিতে কাসাভা উৎপাদন করতে ২০ হাজার টাকা খরচ বাদে কৃষকের ৬ মাসে নিট লাভ হবে ১০ হাজার টাকা, যা পতিত অনুর্বর পাহাড়ি জমির জন্য বেশ লাভজনক।

বিশে^ সবচেয়ে বেশি কাসাভা উৎপাদিত হয় আফ্রিকান দেশ নাইজেরিয়ায়। ২০১৩ সালে নাইজেরিয়ায় ৫৩ মিলিয়ন টন কাসাভা উৎপাদিত হয়। ২০২০ সালে ৬.৯ মিলিয়ন টন কাসাভা থেকে উৎপাদিত স্টার্চ আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয়। কাসাভার রস থেকে পাউডার তৈরি হয়। এই পাউডার তরল করে স্টার্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয় দেশের বস্ত্র ও ওষুধশিল্পে। বস্ত্রশিল্পে সুতা ও কাপড়ের স্থায়িত্ব বাড়াতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ আমদানি করা হয়। দেশে বছরে সাড়ে তিন লাখ টন স্টার্চ আমদানি করা হয়, যার আনুমানিক মূল্য ১৭৫ কোটি টাকার ওপর। স্টার্চের দাম প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। দেশে কাসাভা থেকে স্টার্চ উৎপাদিত হয় ৬ হাজার টনের মতো। বাকিটা ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।

থাইল্যান্ডে কাসাভার ফলন পাওয়া যায় বছরে দুবার। বাংলাদেশেও ওই রকম জাত উদ্ভাবন করা গেলে কৃষক অধিক লাভবান হতেন এবং উৎপাদনও বাড়ত অনেক। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত