ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ঘোড়শাল ইউনিয়নের নারকেলবাড়িয়া গ্রামের সফল খামারি মোখলেসুর রহমান। তিনি কৃষি বিভাগের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০১৬ সালে ভিয়েতনামের খাটো জাতের নারকেল চারা কেনেন। প্রতিটি ৫০০ টাকা করে ২০০ চারা কিনে আড়াই বিঘা জমিতে লাগিয়েছেন। রোপণসহ প্রতিটি গাছের পেছনে তার খরচ হয়েছে ১ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে এই সাত বছরে বিনিয়োগ করেছেন ১০ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু একটি টাকাও তিনি ফেরত পাননি।
মোখলেসুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কৃষি বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল আড়াই থেকে তিন বছরে নারকেল ধরবে। মাটিতে দাঁড়িয়েই ফল ছেঁড়া যাবে। গাছ ঠিকই বড় হয়েছে। মোচাও বেরিয়েছে। কিন্তু নারকেল হয়নি। আর গাছগুলো পোকায় ধরার পর অনেকগুলোই কেটে ফেলেছি। কিন্তু খামারজুড়ে পোকা ছড়িয়ে গেছে। আমি খাটো জাতের নারকেলগাছ লাগিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি।’
শুধু খাটো জাতের নারকেলই নয়, সৌদি খেজুর, মিয়াজাকি আম, ত্বীন ফল, টক আতা, চায়না কমলা, আনারসহ অসংখ্য বিদেশি ফলের বাগান করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন কৃষক ও খামারিরা। অথচ এই চারার বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দেশে বিদেশি ফলের মধ্যে থাই পেয়ারা, বারি মাল্টা-১, ড্রাগন, স্ট্রবেরি ও কয়েক জাতের আম বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছে। তবে খাটো জাতের নারকেল, চায়না কমলাসহ কিছু ফলে আমরা সফলতা পাইনি। এখন এসব চাষে আমরা কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি।’
তিনি বলেন, বিদেশি ফল চাষে সফলতা-ব্যর্থতা থাকবে। কিন্তু যেকোনো বিদেশি ফল আনতে হলে আগে মডেল হিসেবে নিয়ে গবেষণা করতে হবে। ফলাফলটা ভালো পেলে তারপর তা কৃষক পর্যায়ে দেওয়া উচিত। তাহলে খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি ফলের চারা দেশে আনতে হলে আগে যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণার প্রয়োজন। গবেষণার ফলাফল ভালো হলে সেই চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কোনো ধরনের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ফলের চারা আনা হচ্ছে। এরপর ওই চারার বিষয়ে খামারবাড়িতে কর্মরত একজন কৃষি কর্মকর্তা পরিচালিত একটি ইউটিউব চ্যানেলসহ আরও কিছু মাধ্যমে সফলতার প্রচার করা হচ্ছে। এরপর বেসরকারিভাবেও বিদেশি চারা আমদানির দ্বার উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এতে সিন্ডিকেটে জড়িত কিছু ব্যবসায়ী ফলের চারা আমদানি করছেন। ফলে খামারিরা উদ্বুদ্ধ হয়ে চড়া দামে চারা কিনে বিদেশি ফলের বাগান করছেন। কিন্তু বড় ধরনের বিনিয়োগ করে বেশিরভাগ খামারিই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। আর এই বিদেশি গাছের পোকা-মাকড় দেশি অন্যান্য ফলের গাছও নষ্ট করে দিচ্ছে।
নাটোর সদরের সফল খামারি সেলিম রেজা সম্প্রতি তার পুরো বাগানের ১০৭টি খাটো জাতের নারকেলগাছ কেটে ফেলে আলোচনায় এসেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কৃষি বিভাগের প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি প্রতিটি ৫০০ টাকা হিসেবে ১২০টি চারা কিনি। এর মধ্যে ১৩টি আত্মীয়স্বজনকে উপহার দিয়েছি। বাকি ১০৭টি আমার খামারে লাগাই। প্রায় ছয়-সাত বছর সব ধরনের যতœ নেওয়ার পরও ফল ধরেনি। পরে রাগ করে সব গাছ কেটে ফেলেছি।’
জানতে চাইলে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. মেহেদী মাসুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফলের গবেষণায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। কিছু গবেষক আমাদের ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই বিদেশে চলে গেছেন। এরপরও আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমাদের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের ফলগুলোকে আমরা অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। সেখান থেকে গাছের চারা আনছি। আমরা সফলও হচ্ছি। তবে প্রয়োজনীয় পরিচর্যার অভাবে কেউ কেউ ভালো ফল পাচ্ছেন না। এখন পরিচর্যা না করার দোষ তো গাছের ওপর দেওয়া যাবে না।’
একজন খামারি নাম প্রকাশ না করে তার ভিয়েতনাম সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ভিয়েতনামে দেখেছি খাটো জাতের নারকেল চারার দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা। আর যদি আমরা পরিবহন খরচ ধরি, তাহলে ২০০ টাকার বেশি একটি চারার দাম পড়ার কথা নয়। অথচ ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ চারা আনা হয়েছে। সেগুলো দেশে আনা পর্যন্ত খরচ দেখানো হয়েছে ৫১৭ টাকা। আর ১৭ টাকা সরকার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কাছে ৫০০ টাকা করে চারা বিক্রি করেছে। এখানেও বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। এর বাইরে ওই সিন্ডিকেট বেসরকারিভাবেও লাখ লাখ চারা এনেছে।’
কৃষিবিদরা বলছেন, ভিয়েতনামের খাটো জাতের নারকেল সাধারণত ভালো হয় সাগরের প্লাবন এলাকায়। আর সেখানকার লবণাক্ততাও থাকতে হবে কম। কিন্তু বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকা থাকলেও সেখানে পানিতে লবণাক্ততা বেশি।
একজন খামারি জানান, দেশের যেকোনো জায়গায়ই একটা ডাব কিনে খেতে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা লাগে। অথচ তিন-চার বছর আগেও এই অবস্থা ছিল না। এর পেছনে দায়ী খাটো জাতের নারকেল। কারণ কৃষকরা দেশি জাত বাদ দিয়ে প্রায় সবাই খাটো জাতের নারকেল লাগিয়েছেন। কিন্তু পাঁচ-সাত বছর পরিচর্যার পর কোনো ফল পাননি তারা।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেকোনো গাছের চারা আমদানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রের কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। সেটা হচ্ছে প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই যথাযথ প্রক্রিয়া মানে না। ফলে গাছের সঙ্গে রোগবালাইও ঢুকছে।’
তিনি বলেন, অন্য দেশে কোনো ফল ভালো হলেই যে বাংলাদেশেও ভালো হবে তা কিন্তু ঠিক নয়। এ জন্যই কোনো জিনিস হুটহাট করে এনে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। দেশের কৃষি গবেষণা অনেক শক্তিশালী। চারা আমদানি করতে হলে তাদের মাধ্যমে গবেষণা করে যথাযথ ফল পাওয়া গেলেই তা আনা উচিত।
ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার শিবগঞ্জে ২০১৮ সালে ৫০টি সৌদি খেজুরের গাছ লাগান। এর প্রতিটি গাছের চারা তিনি ৯ হাজার টাকা করে কেনেন। তবে ইতিমধ্যে মারা গেছে ১০টি। গত বছর কিছু গাছে ফল এলেও বড় হওয়ার আগেই তা ঝরে যায়। গাছও পোকায় ধরেছে। ইতিমধ্যে কিছু গাছ কেটেও ফেলা হয়েছে।
কালিগঞ্জ উপজেলার তিলেচংপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের আসাদ শেখ লাগিয়েছেন চায়না কমলা। তার গাছগুলোতে একবারে হলদে কমলা ধরে আছে। কিন্তু দেখতে সুন্দর হলেও এতে রস নেই। তেতো স্বাদ, বিচি বেশি। যারাই খেয়েছেন, তারাই গালাগাল করেছেন। আসাদ শেখ বেশ কয়েকবার ফলগুলো বিক্রির উদ্যোগ নিলেও বিক্রি করতে পারেননি। এখন গাছগুলো কেটে ফেলছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের খামারি আকবর হোসেন ১ হাজার ২০০ খাটো জাতের নারকেলগাছ লাগিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে পাঁচ-ছয় বছর যত্ন আত্তি করলেও তাতে ফল ধরছে না। দু-একটি গাছে ফল এলেও ডাবগুলো বড়ই হচ্ছে না।
ফিলিপাইন থেকে আনা এমডি-২ জাতের আনারসের সফলতার গল্প বেশ জোরেশোরে প্রচার হলেও মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। এই আনারসে চোখগুলো বেশি গভীরে না থাকায় সহজে কাটা যায়। তবে বাংলাদেশের আনারসের মতো এই আনারস মিষ্টি ও সুস্বাদু নয়। আর অনেক কৃষকই এই আনারসের চাষ করলেও কারও চারা মরে যাচ্ছে আবার কারও ফল আসছে না।
এভাবে ত্বীন ফলের চারা আনা হচ্ছে জর্ডান ও মিসর থেকে। প্রতিটি চারা তিন হাজার টাকা বিক্রি করা হলেও তাতে যে ফল আসছে তা খাওয়া যাচ্ছে না। টক আতা নামে একটি বিদেশি ফলের চারা বিক্রি করা হচ্ছে ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে। প্রতিটি চারা বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকার ওপরে। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এভাবে মাল্টা, আনারের চারা আনা হচ্ছে মিসর, দার্জিলিং থেকে। কিন্তু বেশিরভাগ বাগানে ফল এলেও তা মুখে দেওয়া যাচ্ছে। ফলের ভেতরটা সাদা, রস নেই।
কয়েক বছর ধরে সাড়া ফেলছে জাপান থেকে আনা মিয়াজাকি বা সূর্যডিম আম। শুরুতে এই গাছের চারা ৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে। এখন ৫০০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দেশে হওয়া এই আমের স্বাদ ভালো নয়। এর ফলনও তুলনামূলক কম।