রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

গুপ্তধনের খোঁজে

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:০৬ এএম

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল দুটি শালিক। এখন আমগাছে বসে ঝগড়া করছে। পাশে কাঁঠালগাছের নিচে কয়েকটা দোয়েল কী যেন খুঁজছে।

বিজ্ঞানী দাদিমা বললেন, বিখ্যাত একটি সমীকরণ আছে,  E=mc2। এটা হলো আইনস্টাইনের সমীকরণ।

প্রীতিলতা বলল, আমি জানি, তবে ব্যাখ্যা করতে পারব না।

E হলো এনার্জি, m হলো বস্তুর ভর আর প হলো আলোর গতিবেগ।

একঝাঁক টিয়ে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। দূরে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।

দাদিমা বললেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী এহসান হক, থাকেন আমেরিকায়। তিনি ম্যাক ও লিসা নামে দুটি কম্পিউটার সিস্টেম উদ্ভাবন করেছেন। সেগুলো মুখভঙ্গি দেখে মানুষের কথা বুঝতে পারে। তিনি কী বলেছেন জানিস?

ওরা মাথা নাড়ে।

‘চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। কী করবি, কী করতে যাচ্ছিস জানতে হবে।’

দাদিমাকে আজ কথায় পেয়েছে। এত কথা তাদের সঙ্গে বলেননি। বললেন, ‘চিন্তা, চেতনা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষের শেখা ও বুঝতে পারার প্রক্রিয়াকে বলা হয় কগনিটিভ প্রসেস। এর মূলে আছে আমাদের মাথা। সেই কগনিটিভ প্রসেসের কাজ যখন আমরা যন্ত্রকে দিয়ে করাচ্ছি, তখন তাকে বলছি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তোদের একটা প্রশ্ন করি, আচ্ছা, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী কি অঙ্ক করতে পারে?’

ওরা ভাবনায় পড়ে। প্রীতিলতা বলে, ‘আমার মনে হয় পারে’।

‘তুই কীভাবে জানিস?’

‘অ্যানিমেল প্লানেট ও ডিসকভারিতে দেখেছি, বাঘ কিংবা সিংহ শিকার ধরার আগে অনেক চিন্তা করে। হিসাব-নিকাশ করে, তারপর দৌড় দেয়।’

‘তা অবশ্য ঠিক। প্রত্যেক প্রাণীর কিছু হিসাব-নিকাশ আছে।’

রোকেয়া বলল, ‘ওদের হাত নেই, কাগজ-কলম নেই। কীভাবে অঙ্ক করবে’?

ওর কথায় সবাই হাসল।

করিম বলল, ‘আমরা মানুষেরা এখনো খুব কম জানি’।

বিজ্ঞানী বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, তোদের সাথে এত কথা কেন বললাম জানিস’?

‘কেন’? ম্যাক্সিম জানতে চাইল।

‘আমার মনে হচ্ছে তোদের মধ্যে কিছু গুপ্তধন আছে।’

‘গুপ্তধন! আমাদের মাঝে! কী যে বলেন না দাদিমা।’

‘কী যে বলেন না দাদিমা।’ ম্যাক্সিমকে ভেঙালেন দাদিমা।

তার ভঙ্গি দেখে সবাই হাসল।

দাদিমা বললেন, ‘আমি যে গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেটা কী জানিস’?

প্রীতিলতা বলল, ‘আপনি পোকার কথা বলেছিলেন’।

রোকেয়া বলল, ‘মানুষের খাওয়ার উপযোগী একটা পোকা আবিষ্কার করতে চাচ্ছেন’।

বিজ্ঞানী মাথা নাড়েন। মুখে বললেন, ‘হ্যাঁ’।

একেকজন তিন-চারটা করে আম খেয়েছে। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আরেকটু পর সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়বে। দাদিমা যাবেন লাইব্রেরিতে আর ওরা বাড়িতে।

যাওয়ার আগে দাদিমা বললেন, ‘মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কী দিয়ে মাপা হয় জানিস’?

ম্যাক্সিম বলল, ‘গায়ের জোর দিয়ে নিশ্চয় নয়’।

‘ঠিক বলেছিস। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব মাপা হয় সৃজনশীলতা আর মানবিক চিন্তা দিয়ে। এ যুগের বিজ্ঞানী হকিং শারীরিকভাবে প্রায় অচল ছিলেন। তারপরও তিনি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। কারণ তিনি চিন্তা করতে পারতেন।’

প্রীতিলতা বলল, ‘আমার বাবা বলেছেন, কখনো কখনো শরীরের চেয়ে মন বেশি গুরুত্বপূর্ণ’।

একটা কাক সামনে দিয়ে উড়ে গেল। পাখির ডানার দিকে চেয়ে দাদিমা গাইলেন, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি/ কেমনে আসে যায়।/ ধরতে পারলে মনবেড়ি/ দিতাম পাখির পায়...

দাদিমা কেমন উদাস, আকাশের দিকে চোখ। তিনি এ জগতে নেই। তার মনটা অন্য জগতে চলে গেছে।

রোকেয়া আপনমনে বলল, ‘দাদিমার কণ্ঠ কী চমৎকার! মনটা ভরে গেল’।

এই গানটা তার মুখস্থ। একটু পর সে গাইল, ‘মন তুই রইলি খাঁচার আশে/ খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে...

রোকেয়ার কণ্ঠ শুনে বিজ্ঞানী চোখ বন্ধ করলেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। গান শেষ হলে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ’!

প্রশংসা শুনে রোকেয়া লজ্জা পেল।

বিজ্ঞানী বললেন, ‘আকাশটা আজ খুব সুন্দর। দেখেছিস? আমার মন বলছে, গুপ্তধন আশপাশে আছে। তোরা যদি মানুষের জন্য কিছু করার শপথ নিতে পারিস, তাহলে খুঁজে পাবি’।

যেতে যেতে ম্যাক্সিমরা ভাবছিল, বিজ্ঞানী দাদিমার গুপ্তধন কি ওরা খুঁজে পাবে?

রোকেয়া বলল, ‘আচ্ছা, তিনি কি সত্যি সত্যি খুঁজছেন’?

‘হ্যাঁ’, বলে প্রীতিলতা মাথা নাড়ল।

ম্যাক্সিম বলল, ‘দাদিমার মাঝে একটা রহস্য আছে। তিনি আমাদের সঙ্গে রহস্যের খেলা খেলছেন’।

দাদিমার রহস্যের ভেতর আমাদের ঢুকতে হবে, রোকেয়া বলল।

ঠিক হলো, শুক্রবার বিকেলে ওরা প্রীতিলতার বাড়িতে যাবে।

শুক্রবার সকালে ওরা নিজেদের কাজ সেরে ফেলল। কিছু পড়া বাকি ছিল, তা রাতে করবে বলে রেখে দিল।

প্রীতিলতার ছোট বোন আছে। তার নাম সোমলতা। সে মোবাইলে ডায়ানা অ্যান্ড রোমা দেখছিল। একটা কুমির আসে, দেখে মেয়েটা ভয় পায়। পরে দেখা যায় ওটা খেলনা কুমির। একটা বড় সবুজ সাপ আসে। ওটা দেখে মেয়েটা ভয় পায়। পরে দেখা যায় ওটা খেলনা সাপ।

ওরা মোবাইলে চোখ রাখলে সোমলতা ওটা পাল্টে দেয়। সে তখন আপেল, কমলা, স্ট্রবেরি ও চেরি ফল আঁকা ও রঙ করা দেখে। তার কা- দেখে ওরা হাসে।

প্রীতির মা বলেন, ‘অভিযাত্রীর দল, কেমন আছিস’?

‘অভিযাত্রী’ শুনে ওরা একে অপরের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। মুখে বলল, ‘ভালো আছি কাকিমা’।

মা হেসে বললেন, ‘তোদের আজ খাওয়াব নাড়– আর সন্দেশ’।

সন্দেশের কথা শুনে সবার জিবে পানি এসে গেল।

‘গুড়ের সন্দেশ’? রবি জানতে চাইল।

তিনি মাথা নাড়লেন।

কাকিমার বানানো সন্দেশ খুব মজার। ওরা অনেকবার খেয়েছে। কাকিমা বললেন, ‘যা, লাইব্রেরিতে গিয়ে বস’।

প্রীতিলতার বাবা সাংবাদিক। ঢাকায় থাকেন। তাদের ঘরে একটা লাইব্রেরি আছে। ওখানে অনেক বই। প্রতিবার এলে ওরা পছন্দমতো বই নিয়ে যায়।

ওরা দেখল কার্ল মার্কসের ‘পুঁজি’, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, মিলান কুন্ডেরার ‘ঠাট্টা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’। প্রীতিলতার আলাদা তাক আছে। ওখানে দেখল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজ্ঞানরহস্য’, ‘বাঙালির রূপকথা’, আলেকজান্ডার ডুমার ‘দি থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, সফিক ইসলামের ‘গণিত আমাদের কী কাজে লাগে’।

কাকিমা খেতে ডাকলেন। কেউ প্রথমে সন্দেশ খেল, কেউ খেল নাড়। প্রীতিদের একটা গাভী আছে। এরপর এলো গরুর দুধের ঘন সর দেওয়া চা। খেয়ে ওরা আবার লাইব্রেরিতে ঢুকল।

বুড়া দাদু বলেছিলেন, নিজের স্বপ্ন সফল করতে হলে নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হয়।

রোকেয়া পেপারে যুদ্ধের খবর দেখে জিজ্ঞেস করল, পৃথিবী থেকে যুদ্ধ যাবে না?

যুদ্ধের কথা শুনে ওদের মন খারাপ হয়ে গেল। ওরা জানে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাখ লাখ শিশু কষ্টে আছে। ইয়েমেন, সিরিয়া ও আফ্রিকায় কষ্ট করছে লাখ লাখ শিশু। সুদানের মানুষ শান্তিতে নেই। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পৃথিবীতে সংকট তৈরি করেছে। মাঝে মাঝে পত্রিকায় ছবি দেখে ওদের খুব মন খারাপ হয়। ওরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু করতে চায়, করার কথা ভাবে।

ম্যাক্সিম বলে, ‘আমার মনে হয়, গুপ্তধন বলতে দাদিমা আমাদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কথা বলেছেন’।

প্রীতিলতা বলল, ‘তোর এমন মনে হলো কেন’?

দাদিমা বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যেও গুপ্তধন আছে’।

‘না, আমার মনে হয় তিনি জ্ঞানের কথা বলেছেন। জ্ঞান আমরা অর্জন করতে পারি। জ্ঞান তো এক ধরনের সম্পদ। এটা গুপ্ত থাকে।’

প্রীতিলতার মনে আরেকটা সম্ভাবনার কথা উঁকি দিল। সে পোকার কথা ভাবল, কিন্তু এখনই কথাটা বলল না। আরও ভাবতে হবে, মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তারপর বলবে।

রোকেয়া বলল, ‘জ্ঞানের কথা রাখ। একটা কবিতা পড়ি, শোন : চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর,/ নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান!/ ফসল উঠিছে ফ’লে, রসে রসে ভরিছে শিকড়;/ লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ!...

অদ্ভুত এই কবিতাটি কার? রবি প্রশ্ন করল।

জীবনানন্দ দাশ, বই থেকে চোখ সরিয়ে রোকেয়া বলল। তার হাতে ‘জীবননান্দ দাশের কবিতাসমগ্র’।

‘দাদিমার প্রজাপতি?’

রোকেয়া হেসে বইটি তাকে রাখল।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত