সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫, ১০ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

ভারতবর্ষে বাহারি ইফতারের ইতিহাস

আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৭ পিএম

ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজান। এ মাসে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার ব্রত নিয়ে মুসলমানরা সিয়াম সাধনা করে। এ মাসের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো ইফতার। ইসলাম ধর্মমতে রমজান মাসে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা সুন্নাত। কারণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতার করতেন খেজুর দিয়ে। তবে খেজুরের পাশাপাশি ভারতবর্ষে বাহারি ইফতারের প্রচলন ঘটেছে বেশ আগে থেকেই।

ভারতবর্ষে রোজার মাসকে উৎসবমুখর করেছিল মুঘল শাসকরা। রমজান মাস শুরু হওয়ার পূর্ব সন্ধ্যায় বাহাদুর শাহ জাফর হাতি নিয়ে বের হতেন চাঁদ দেখতে। আকাশে চাঁদ দেখা গেলে কামান থেকে তোপ ছুড়ে অথবা শূন্যে গুলি করে রমজান মাসের বার্তা জানিয়ে দেওয়া হতো। বাংলা অঞ্চল যখন মুঘলদের অধীনে তখন এই রেওয়াজ বাংলাতেও ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবরাও তোপ-কামান দেগে রমজানের ঘোষণা দিতেন। বলা হয় মুঘলরা সঙ্গে করে বাবুর্চি নিয়ে এসেছিল। সালমা ইউসুফ হুসেইন রচিত ‘দ্য মোগল ফিস্ট: রেসিপিজ ফ্রম দ্য কিচেন অব এম্পায়ার শাহজাহান’ নামক গ্রন্থে মুঘল শাসনামলের বিচিত্র রন্ধনশৈলীর বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। রমজান মাসে মুঘলদের ইফতারে ছিল- তরমুজের শরবত, তন্দুরি ও নান রুটি, বহু রকমের কাবাব, বিরিয়ানি, কোর্মা, কোফ্তা আর হালিম। সেই সঙ্গে জিলিপি, নিমকপারা ও সমুচার মতো কিছু খাবার। তন্দুরি ও নান রুটি ছিল হরেক কিসিমের। যেমন বিভিন্ন ধরনের বাদাম দিয়ে তৈরি করা হত তাফতান। মুঘল কিচেনে তৈরি হয়েছিল মোরগ মোসাল্লম। এই রান্নায় মশলার ভূমিকা অনন্য। মোরগের ভেতরে প্রয়োজনীয় মশলা দেওয়ার পর সেদ্ধ ডিম পুরে শিকে গেঁথে আগুনে সেঁকা হতো। সেই সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা ঘি ছড়ানো হতো উপর থেকে। মুঘলরা বিভিন্ন ধরনের কাবাব ইফতারে খেতেন। কাবাবের মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় ছিল পারসান্দের শিক কাবাব। নরম গোশতের ১০-১২ টুকরো দিয়ে কাঠ কয়লার আগুনে পুড়িয়ে এই কাবার তৈরি করা হতো। এছাড়া ইফতারে খাওয়া হত হান্ডি কাবাব, শামি কাবাব, টিক্কা কাবাব, তাশ কাবাবও।

শুধু মশালাদার খাবার নয়, ভারতীয় রন্ধনশৈলীতে বিবিধ মিষ্টি তৈরিতেও মুঘলদের অবদান রয়েছে। ইফতারির সময়ে অনেকেই জিলিপি বা জালেবি খেতে ভালবাসেন। সেই জিলিপির প্রবর্তনও হয়েছিল মুঘলদের হাতে। এছাড়া ইফতারে পছন্দের তালিকায় থাকে শিরমাল ও শিরবেরেঞ্জ। বাংলায় বিখ্যাত এই শিরমাল এসেছিল মুঘলদের অনুকরণ করেই। মূলত সুজি দিয়ে তৈরি হয় শিরমাল। এছাড়া দুধ, মধু, মাওয়া এবং কিশমিশ দিয়ে রমজান মাসে শিরবেরেঞ্জ নামে একটি খাবার তৈরি করা হতো। ইফতার ও সাহ্‌রি—দুবেলাতেই তা খাওয়া হতো। প্রায় সবসময়ই ইফতারে জনপ্রিয় ছিল বহু রকমের শরবত। বিভিন্ন রকমের বাদাম দিয়ে তৈরি হতো নানা ধরনের শরবত। তাতে দেওয়া হত জাফরান, সুগন্ধি আর গোলাপ জল। অভিভক্ত বাংলায় রমজানের প্রথম ও ২৭ তারিখ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই দুদিন বড় ডালা পাঠানো হত মসজিদে মসজিদে। আত্মীয় পরিজন ও মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর রেওয়াজটা তখন থেকেই শুরু হয়। মুঘলদের হাত ধরে ঢাকা শহরেও ইফতারের রীতি–রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। এ ব্যাপারে কবি শামসুর রাহমান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “বাড়িতে ইফতারির সরঞ্জামের অভাব ছিল না, কিন্তু চোখ পড়ে থাকত সিতারা মসজিদের বারান্দায়। শুধু মনে হতো, ওই মুড়ি, ফুলুরি, দোভাজা, ছোলা আর বেগুনি মেশানো খাবারটা যেন রূপকথার দেশ থেকে এসেছে, আমাদের রোজকার দেখা ধরাছোঁয়ার বাইরের জিনিস’’।

বাংলার ইফতারে যেমন মুঘল রেসিপির প্রভাব লক্ষ্যণীয় তেমনি পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপেও। পাকিস্তানে ইফতারে রুটি ও মাংস বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল, ফলের সালাদ, ফালদা, জুস, বিভিন্ন ধরনের শরবত, জিলিপি, রোল, টিক্কা, তান্দরি কাটলেট, কাবাব, নুডুলস কাবাব, সফিয়ানি বিরিয়ানি ইত্যাদি। মালদ্বীপে ইফতারে শরবত, ছোলা বুট, হালিম, মাশরুহি ভাজা মাছ বেশ জনপ্রিয়। আফগানদের ইফতারির টেবিলে সুরওয়া নামের এক ধরনের স্যুপ থাকে। সঙ্গে থাকে রুটি, ভেড়ার গোশতের দোপেঁয়াজা, মুরগির কাবাব, খাসির কাবাব। মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে থাকে শিরনি আর পায়েস। পুরো আফগানিস্তানে বড় ঐতিহ্য কাবুলি পোলাও। তাঁদের ইফতারে পাকোড়া আর আমানতু আশ থাকে। পাকোড়া বানানো হয় মুরগির গোশত, আলু ও ঘি দিয়ে। 

এতো বাহারি ইফতারির বিবরণ মূলত সব যুগেরই উচ্চবিত্তের জন্য। এতসব বাহারি স্বাদে অন্তর তৃপ্ত করার সুযোগ কোন কালেই সাধারণ মানুষের নাগালে ছিল না। মুঘল জমানায় নবাবরা মুসাফিরখানা ও মসজিদে সাধারণ গরিব মানুষকে বিনামূল্যে ইফতার করাতেন। এই ঐতিহ্য এখনও কোথাও কোথাও টিকে রয়েছে। ঔরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তার ও বাহাদুর শাহ জাফরের সময়ে ইফতারের সময়ে দরবারি খানা পেশ করা হতো  সাধারণ মানুষকে। এখনও সেই ‍ঐতিহ্য বাংলাদেশে বেশ লক্ষ্যণীয়। বিত্তবানরা এখনও চেষ্টা করে গরীব-দুখীদের ইফতারে পাশে দাড়াতে।

বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে ইফতার কখনই শুধু রোজা ভাঙার উপলক্ষ্য ছিল না, যার যতটুকু আছে ততটুকুতেই তুষ্টি খুজে এটিকে একরকম উৎসব হিসেবে পালন করার চেষ্টা করে। ইফতার এখন বিশ্ব সংস্কৃতিক ঐতিহ্য । গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ইফতারকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। এই ঐতিহ্য টিকে থাক অনন্তকাল। 

লেখক: মো. কবির হাসান, প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত