চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকায় সিটি করপোরেশনের (চসিক) হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রশংসিত হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভবপর হয়নি। এখনো সন্ধ্যার পর থেকে আগের মতো বসে পড়ছে তারা। জানিয়ে রাখা ভালো, সড়কটি প্রায় ৬০ ফুটের মতো। দুইপাশে ফুটপাত আছে আরো দশ ফুট করে ২০ ফুট। প্রত্যেকপাশে ফুটপাতের ১০ ফুটের মধ্যে ৮ ফুট এবং মূল সড়কে নালাসহ ১০ ফুটে আবার হকার, ২-৩ ফুট খালি রেখে আবার হাতে মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ভ্যান বা অন্য সরঞ্জামসহ হকারের দখলে ৩-৫ ফুট, এরপর খালি রিকশা/ভ্যান বা টেক্সিসহ দাঁড়িয়ে থাকা অন্য গাড়ির দখলে ৫-৭ ফুট। অবশিষ্ট ৭-৮-৯ ফুটে চলছে যানবাহন; যার জন্য চলতি পথের গাড়ি বা যাত্রীদের কষ্টের কোনো সীমা নেই।
এদিকে কর্মঘণ্টা নষ্ট হলেও কারো যেন করার কিছু নেই। নানা নামে হকার সংগঠন খুলে চলছে নৈরাজ্য। স্থানীয় সরকার প্রশাসনের অধীনস্থ সংস্থা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার বিধানে রয়েছে সড়ক হবে হকারমুক্ত। ট্রাফিক পুলিশ সংস্থার বিধানে রয়েছে সড়ক হবে হকারমুক্ত। সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিধানে রয়েছে সড়ক হবে হকারমুক্ত। বিআরটিএ’র বিধানে রয়েছে সড়ক হবে হকারমুক্ত। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিধানে রয়েছে সড়ক হবে হকারমুক্ত। মানে সকল সংস্থার বিধানে চলাচলের পথ নির্বিঘ্নভাবে শুধুমাত্র যান ও জন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে। আর এসব স্থান নির্বিঘ্নে দখল করতে হকাররা সংঘবদ্ধ হয়ে সংগঠন গড়ে তুলছে। এসব সংগঠনের বৈধতা দিচ্ছে শ্রম অধিদপ্তর, যা সাংঘর্ষিকই বটে।
অন্যদিকে নিবন্ধিত সংগঠনের দোহাই দিয়ে চাঁদার টাকায় রাজনৈতিক নেতাদেরও অংশীদার করা হয়। দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক টাকা পেয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন, হকাররা যাবে কোথায়? পুনর্বাসনের দাবি তোলেন। তাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন– কতবার পুনর্বাসন করা হবে? তাদের কি পুরো শহর রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে?
খেয়াল করুন, নিউ মার্কেটের পাশের জহুর হকার্স মার্কেট কিন্তু এই পুনর্বাসনের উদাহরণ। একইভাবে আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর মার্কেট, সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক সমবায় মার্কেটও পুনর্বাসিত হকারদেরই মার্কেট। চাউর আছে– হকারদের মধ্যে যারা পুনর্বাসিত হয়েছিলেন তারা অনেক বেশি টাকায় তাদের দোকানগুলো বিক্রি করে সড়কে এসে আবার হকার সেজে বসেছেন। অথবা তার কোনো ছেলে বা আত্মীয়-স্বজন কাউকে সড়কে বসিয়েছেন। কারণ সড়কে বসার জায়গাটি তাদের এককালীন টাকায় নিতে হয়। কেউ কেউ আবার সেই জায়গা অন্যের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।
কারা হকার
সর্বপ্রথম যারা সড়কে বসেছিল মূলত তারাই অনেকে বংশ পরম্পরায় হকার। এদের সাথে নতুনরাও যুক্ত হয়। কেউ পজিশন বিক্রি করে দেয়। মার্কেটকেন্দ্রিক অনেক দোকান মালিক বা তাদের কর্মচারীদের আত্মীয়-স্বজনরাও হকার হিসেবে রয়েছেন। অনেক দোকান মালিক বাড়তি আয়ের জন্য লোক লাগিয়েও হকারি করাচ্ছেন। এদের মাধ্যমেই মূলত জায়গার পজিশন এককালীন বেচাকেনা বা ভাড়ায় দেওয়া হয়।
পজিশনে কারা
অনেক মার্কেটের দোকানের সামনের জায়গাটুকু প্রতিষ্ঠানের মালিকই ভাড়া দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকও ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে এই কাজে অংশ নিচ্ছেন। এভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা স্থানীয় প্রভাবশালীর আশ্রয়ে থাকা কতিপয় ছাত্রনেতারাও এ কাজে যুক্ত রয়েছেন।
চাঁদা আদায়
উল্লিখিতরা দৈনিক হারে চাঁদা আদায় করে চলেছেন, কেউ কেউ মাসিক হারে নেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৈনিক হারেই চাঁদা আদায় করা হয়। দৈনিক হারে আদায়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা বা টহল পুলিশের জন্য নির্ধারিত একটি অংক রয়েছে।
কয়েক স্তরে চাঁদাবাজি
কথিত রয়েছে, হকার সংগঠন, চসিকের পরিদর্শক, টহল বা ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় চাঁদাবাজ, হকার টাউট, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামেও চাঁদা আদায় হয়। চাঁদার অংশ রাজনৈতিক নেতাদের পকেটসহ প্রশাসনেও যায় বলে প্রচার আছে। এর ফলে উচ্ছেদ কার্যক্রমের সুফল মেলে না বলেই ধারণা সাধারণ মানুষের। এছাড়া জনগণের বাসা-বাড়ি ভেঙে হাজার কোটি টাকায় সড়ক সম্প্রসারণ করার পরও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েকবার উচ্ছেদ কার্যক্রম
সম্প্রতি চসিকের উচ্ছেদ কার্যক্রমকে অন্যবারের চেয়ে একটু বেশি কার্যকর মনে হচ্ছে। কারণ গেল ঈদের সময়েও হকারদের দিনের বেলায় বসতে দেওয়া হয়নি। উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। যদিও এর আগে অনেক সময় চালানো উচ্ছেদ অভিযানগুলো লোক দেখানো ছিল বলে সবাই বলাবলি করছিল। একবার তো প্রশাসনের এক বড় কর্মকর্তা এসেই ঘোষণা দিলেন শহরে হকার থাকবে না। হলো উচ্ছেদ কার্যক্রম। পরে দেখা গেল– হকাররা আবারো বসল। খবর নিয়ে জানা গেল– আগে হকাররা ১০০ টাকা দিতেন। পরে সেটা ২০০ টাকা হয়েছে।
এরপর আরেক কর্তাব্যক্তিকেও দেখা গেল– হকারদের উচ্ছেদ ও গালাগালি করে ভাইরাল হয়েছেন। পরে যখন চুপ হয়ে গেলেন– তখন সবাই বলাবলি করল নিশ্চয়ই লোভের বশে হম্বিতম্বি করে নিজের অংশটা নিশ্চিত করতেই গিয়েছিলেন। যারা একসময় উচ্ছেদের কথা বলেন– পরে আবার তাদের পুনর্বাসনের কথাও বলতে শোনা যায়। মূলত পেছনে একটা ‘লাভসত্ত্ব’ থাকে বিধায় একেক সময় একেক কথা বলেন তারা।
লাভ-ক্ষতি
হকারদের কাছ থেকে রাষ্ট্রের কিছুই পাওয়ার নেই। এরা কোনো ধরনের কর পরিশোধ করে না। মানুষ তাদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য পাচ্ছেন বলে যে কথা বলেন– সেটা আসলে সত্য নয়। কারণ তাদের পণ্য নকল, সেকেন্ড হ্যান্ড বা মানসম্মত হয় না; ফলে দামটা কম। এ ধরনের পণ্য যদি দোকানের মাধ্যমে বেচাকেনা হয় সেখানে ন্যূনতম ট্রেড লাইসেন্সের মাধ্যমে হলেও সরকার একটি কর পেত। কিন্তু হকারদের তো ট্রেড লাইসেন্স করতে হয় না।
তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের চাঁদা প্রদানের পর যে পণ্যটি তারা কম দামে বিক্রি করছে– সেটি যদি দোকানে বিক্রি করা হয় তাহলে আরো কম দামে বিক্রি করা যাবে। কারণ ওই পণ্যের চাঁদা লেনদেনের অংশ পাবলিকের ঘাড়ে বর্তাবে না। আর বর্তালেও এতটা বেশি হবে না।
হকারদের কারণে যানজট হচ্ছে। সেখানে গাড়ির তেল পুড়ছে। মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রসারিত সড়কের সুফল আসছে না। বখাটে চাঁদাবাজ শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। হকার উচ্ছেদ হলে অনেকে বলেন, এরা কি করে খাবে? এরা তো ছিনতাইয়ে নেমে পড়বে। তাদের কাছে জিজ্ঞাসা– হকাররা থাকা অবস্থায় কি শহরে ছিনতাই কম হচ্ছে? আর শহরে এসে সড়ক দখল করে ব্যবসা করা যাচ্ছে বিধায় গ্রামে কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য অনেক গৃহস্থ পরিবার গৃহস্থী ছেড়ে দিয়েছে।
আবার বলতে পারে, শহরে হকারি করে তো কেউ বড়লোক হচ্ছে না। খবর নিলে জানা যাবে চড়া সুদে হকারি করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সবাই। একটি চক্র চড়া সুদে তাদের ঋণ দিচ্ছে। অনেক হকার আবার ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাই ঝুঁকি জেনেও অনেকে চড়া সুদে পুষিয়ে নিচ্ছে ক্ষতিটা। এখানেও রাষ্ট্র কোনো কর পায় না।
শক্তিশালী করতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতি
শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতি গড়তে হলে অবশ্যই শহরকে হকারমুক্ত করতে হবে। শহরে যখন হকারি করার সুযোগ থাকবে না এই পেশার মানুষেরা গ্রামেই থেকে যাবেন। সেখানে হাজার হাজার হেক্টর অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ হবে। লোকবল সংকট থাকবে না। ফসলেও ভরপুর হবে গ্রাম। আবারো অতীত ফিরে পাবে বাংলার গ্রামীণ জনপদ। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশগুলোই নেতৃত্ব দেবে ও টিকে থাকবে। আমাদেরও সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য শহরের ওপর চাপ কমাতে হবে।
স্থায়ীভাবে হকারমুক্ত রাখতে যা করতে হবে
চসিকের হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে বর্তমান মেয়রের ইচ্ছা আছে। কারণ তিনি ফুটপাতে দৃষ্টিনন্দন বাগানের পজিশন সৃষ্টি করেছেন। অভিযান চলমান রেখেছেন। কয়েক দফায় হকারদের সাথে অভিযান টিমের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। অভিযান টিম বলতে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর সংঘর্ষ মানে আদালতের সাথেই বোঝায়। সুতরাং এখানে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। আদালতের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে হকার সংগঠন নেতাদের আসামি করে মামলা করতে হবে। এছাড়া ধরপাকড় অব্যাহত রেখে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
চসিকের এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত পরিদর্শককে ফুটপাত বা সড়ক দখল করে কেউ বসতে দেখলে বাধা দিতে হবে। কোনো ধরনের সুবিধা নিয়ে হকার বসালে তাকে বিনা নোটিশে চাকুরিচ্যুত করতে হবে। একইভাবে টহল/ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বরতদেরও কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই হকাররা বসতে পারবে না। ন্যূনতম সহনশীলতা থেকে প্রশ্রয়েরও জন্ম হয়। তাই সবক্ষেত্রে কঠোরতাই পালন করতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে বেশিরভাগ আইন বাস্তবায়ন হয় না সহনশীলতা, প্রশ্রয় ও অবৈধভাবে সুবিধা নেওয়ার কারণে। অবশ্যই চাকুরিচ্যুত করতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া বিদ্যুৎ বিভাগের সুবিধাভোগী সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের মাধ্যমে তাদের অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তাদের সাজাও নিশ্চিত করতে হবে।
হকার সংগঠনের গুটি কয়েক নেতার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে সুবিধাভোগী শ্রেণিকেও বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ফুটপাতে কোনো হকার বসলে তার সামনে বা আশেপাশের দুটি দোকান মালিককে জরিমানার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে অভিযানের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। কোনো দোকান থেকে ফুটপাত বা সড়কের কোনো ভ্রাম্যমাণ দোকানে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হলে সেই দোকানের বিদ্যুৎ সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। আর সড়কের খুঁটি থেকে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হলে এজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যুতের লাইনম্যানসহ কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এজন্য যে তাদের কারণে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে, অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে কেউ; যার জন্য গ্রাহককে বাড়তি টাকায় বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। জনগণের পকেট কাটা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ওয়াসা, চউকসহ সব সেবা সংস্থায় নিয়োজিত কর্মচারী-কর্মকর্তাকে একইভাবে কঠোর নির্দেশনার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মোট কথা, পরিচ্ছন্ন নগর চাই। নির্বিঘ্নে চলাচলের সড়ক চাই। জনগণের এই দাবি যেন কোনো দিনই বাস্তবায়ন হবার নয়। নিউ মার্কেট এলাকা হকারমুক্ত রাখার কার্যক্রমে সাধুবাদ পাওয়া সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অন্য সেবা সংস্থাগুলোকেও কাঁধে কাঁধ মিলাতে হবে। কারণ এ কাজ একা মেয়রের নয়। এ কাজ বাস্তবায়নে চাই সবার অংশগ্রহণ।
লেখক: সাংবাদিক