১৯৬০ সালে উত্তর-পূর্ব ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে ইব্রাহিম রাইসির জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন আলেম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বাবাকে হারান রাইসি। পরে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কওম সেমিনারি, অর্থাৎ ইরানের বৃহত্তম ইসলামি সেমিনারিতে যোগ দেন তিনি।
ছাত্র থাকাকালেই তিনি পশ্চিমা-সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। পরে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে এক ইসলামি বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হন শাহ।
মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তেহরানের পাশর্^বর্তী শহর কারাজের প্রসিকিউটর-জেনারেল নিযুক্ত হন এবং ২৫ বছর বয়সে তেহরানে ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৮৯ থাকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তেহরানের প্রসিকিউটর-জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন রাইসি। ২০০৪ সাল থেকে তিনি এক দশক জুডিশিয়াল অথরিটির উপপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি।
নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোর বিরোধী হিসেবে প্রকাশ করা রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে শিয়া ইসলামি কট্টরপন্থার সমর্থক। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোরও কঠোর সমালোচক।
বিশ^নবীর রক্ত সম্পর্কিত উত্তরাধিকার দাবি জানিয়ে সব সময় কালো রঙের পাগড়ি পরিধান করতেন তিনি। আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থিরা, যারা ক্ষমতাসীন ইসলামি কট্টরপন্থি সরকারের বিরোধী। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তেহরানের রেভল্যুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে সময় রেভল্যুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন তিনি।
যদিও ইরান কখনো এই গণমৃত্যুদণ্ডের কথা স্বীকার করেনি। রাইসির ভূমিকা নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কখনো কিছু বলেননি।
রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ডের ফলে রাইসি ইরানের বিরোধীদের মধ্যে বেশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান ইব্রাহিম রাইসি। কিন্তু রাইসিকে হারিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট রাইসি পরে ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ সভার উপচেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এ সভা। তবে ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করে ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইব্রাহিম রাইসি।
কট্টরপন্থি হিসেবেই বেশি খ্যাতি পেয়েছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা আটকে যায় এবং ২০২২ সালের শেষের দিকে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশটিতে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়।
রাইসির সময় ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ বাড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। এ ছাড়া ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুতি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।
এ ছাড়া রাইসি সরকার, সামরিক এবং আইনসভার সব শাখার পাশাপাশি শক্তিশালী ধর্মতান্ত্রিক শাসকশ্রেণির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তার সময়ই ইরানে নারীদের হিজাব পরিধান নিয়ে কড়াকড়ি আইন আরোপ করা হয়; যার জেরে প্রাণ হারিয়েছে একাধিক নারী।