প্রতি বছর ১৪ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। বছরে দেশে রক্তের চাহিদা প্রায় ১০ লাখ ব্যাগ। কিন্তু নিরাপদ রক্তের জোগান প্রয়োজনীয় রক্তের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। তরুণ প্রজন্মের স্বেচ্ছায় রক্তদানই হতে পারে এই সংকটের সমাধান। লিখেছেন জান্নাতুল আদন
‘আমার নিজেরই যে অবস্থা! শরীরে সুচ ঢোকাবে, কী না কী বিপদ হয় আবার। থাক বাবা। অন্য কেউ দিয়ে দেবে নিশ্চয়ই, আমার দরকার নেই!’
যারা কখনো রক্তদান করেননি, প্রথম রক্তদানের প্রস্তাব পেয়ে তাদের কারও কারও মনে এ রকম নানাবিধ ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারে বৈকি! এমন নয় যে, রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে তারা অন্যদের চেয়ে কম জানেন বা প্রাণ বাঁচাতে রক্তদানকে কম মহৎ মনে করেন। তবে দ্বিধা কাটিয়ে নিয়মিত রক্তদাতা হওয়ার পথে তাদের মানসিক বাধাও কম শক্তিশালী নয়। এ কারণেই প্রয়োজনের তুলনায় নিয়মিত রক্তদাতা আমাদের দেশে এখনো অপ্রতুল। জোর দিয়ে এ কথা বলার কারণ রক্তের অভাবে রোগীর মৃত্যুর পরিমাণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশের ১-৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে দেশের রক্তের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব। বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে এক বছরে রক্তের চাহিদা প্রায় ১০ লাখ ব্যাগ। দুঃখজনক হচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে এ চাহিদার মাত্র ৩৫ শতাংশ পূরণ হয় স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের মাধ্যমে। বাকি একটা বড় অংশ পূরণ হয় পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া রক্ত দিয়ে। আর যা পূরণ হয় না, সেসব রোগীর মৃত্যুর সরকারি পরিসংখ্যান নেই।
বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, চাহিদার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ তিন লাখ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের ঘাটতি থেকে যায়। পাঁচ কোটির ওপরে তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশে মাত্র দশ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা পূরণ না হওয়া এবং কয়েক লাখ রোগীর মৃত্যুকে মানসিক বাধার এক নির্মম পরিহাস হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।
সমস্যা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু! পেশাদার রক্তদাতাদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। এদের রক্ত নিয়ে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায়। আবার যখন আত্মীয়, বন্ধু ও স্বজনদের ধরে রোগীর রক্তের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তখনো কিন্তু রোগী ঝুঁকিমুক্ত হচ্ছেন না।
প্রথমত, একই ব্লাড লাইন বা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের রক্তে জেনেটিক্যাল অনেক মিল থাকে। এই মিলের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর শরীরের বর্তমান রক্ত নতুন রক্তকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘ট্রান্সফিউশন অ্যাসোসিয়েটেড গ্রাফট ভার্সাস হোস্ট ডিজিজ’ (TA-GVHD)। এই রোগটি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে হয় না, তবে হলে মৃত্যুঝুঁকি ১০০%। তাই রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের নেওয়া রক্তও রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, দূর সম্পর্কের আত্মীয় ও পরিচিতদের রক্ত নিতে গিয়ে সময় এবং পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যগত অনেক বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়। যেমন- রক্তদাতা হয়তো এলার্জির ওষুধ খাচ্ছেন, এক মাসের মধ্যে কোনো ভ্যাকসিন নিয়ে ভুলে গেছেন, হিমোগ্লোবিন লেভেল হয়তো প্রয়োজনের চেয়ে কম। তাড়াহুড়োর কারণে এ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। ফলে দীর্ঘমেয়াদে রোগীর শরীরে জটিল ব্যধি সৃষ্টি করতে পারে। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে প্রয়োজন নতুন সংস্কৃতির চর্চা। এ চর্চায় প্রতি ৪ মাস অন্তর একটি ভালো, বিশ্বস্ত ও উন্নত মানের ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে রক্ত দেওয়া; যেখানে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে রক্ত নেওয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ ও বিশুদ্ধ রক্তের গাইডলাইন হিসেবে প্রতি ব্যাগ রক্তের জন্য পাঁচটি টেস্ট নির্ধারণ করেছে। হেপাটাইটিস বি, সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি। এ পাঁচটি টেস্টে উত্তীর্ণ রক্তই বিশুদ্ধ রক্ত হিসেবে রোগীর শরীরে নেওয়া নিরাপদ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো রক্তবাহিত রোগের এভাবেই মোকাবিলা করছে।
আমাদের তরুণদের একটা বড় অংশ স্বেচ্ছা রক্তদানে আগ্রহী। কিন্তু তারপরও দেশের রক্তচাহিদা পূরণ না হওয়ার মূল কারণ রক্তদানে নিয়মিত হওয়ার অনীহা। মানবদেহে প্রতি চার মাসে রক্তকণিকাগুলো নতুন করে উৎপাদিত হয়। পুরনো কণিকাগুলোর জীবনাবসান হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, রক্তদানের ফলে দাতার শরীরের অস্থিমজ্জায় রক্ত কণিকাগুলোর উৎপাদন বাড়ে। এর প্রভাবও ব্যাপক। ত্বকের লালিত্য, বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমানো থেকে শুরু করে বহুবিধ উপকারিতা সত্ত্বেও নিয়মিত রক্তদানে আগ্রহী স্বেচ্ছা দাতার সংখ্যা আমাদের দেশে তুলনামূলক কম।
প্রতি বছর ১৪ জুন পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। নোবেলবিজয়ী জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার ১৯০০ সালে প্রথম ব্লাড গ্রুপ আবিষ্কার করেন। এটি চিকিৎসাশাস্ত্রে অনন্য একটি আবিষ্কার। তার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার জন্মদিন ১৪ জুনকে এ দিবস পালনের জন্য বেছে নেয়। দিবস পালন আসলে মানুষকে প্রাকৃতিক নিয়মকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার একটা উপলক্ষ মাত্র! আর অন্যের কল্যাণে নিজের কিছু দান করলে তা কমে না, বরং বাড়ে। রক্তদানের ক্ষেত্রেও বিষয়টি তাই। দান করলেই দাতার শরীরে রক্তের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের ১৭ কোটি মানুষের দেশে, রক্তের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশে রক্তের অভাবে মানুষ মারা যাবে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করাই তরুণপ্রাণের মানসিক বাধা দূর করার জন্য যথেষ্ট। এ জন্য তরুণদের মাঝে রক্তদান সম্পর্কিত চাহিদা ও বাস্তবতাগুলো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। রক্তের অভাব নয় বাংলাদেশ যেন পরিচিতি লাভ করে বিশ্বের সর্বোচ্চ নিরাপদ রক্ত সরবরাহকারী দেশ হিসেবে। এবারের বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উদযাপনের এই মাসে এই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন। পরিকল্পনা ও কর্মতাড়িত হোক লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে। শুরু হোক নতুন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা, রক্তদানের সময় হলেই বিশ্বস্ত ও উন্নতমানের ল্যাবে গিয়ে রক্তদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। যে কেউ নিজেই এ উদ্যোগ শুরু করতে পারেন নিজে নিয়মিত রক্তদান ও পরিচিতদের, বিশেষ করে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে। বিন্দু বিন্দু জল যেমন মহাসাগর গড়ে তোলে তেমনি প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগই একসময় তৈরি করবে নতুন সংস্কৃতি।
লেখক : নিয়মিত রক্তদাতা ও তরুণ সংগঠক