বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চিরতরুণ তারকাদের খোঁজখবর

আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪, ১১:২৯ এএম

বাঙালি সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে অনেকেই কর্মব্যস্ত নানা অঙ্গনে। দিব্যি কাজ করছেন তারা সুস্থ শরীরে। কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তবু তারা সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করেন। এখনো সুস্থ আছেন ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর ৮৩ বছর বয়সী ফেরদৌসী রহমান। নিয়মিত সংগীতচর্চায় না থাকলেও টুংটাঙে সময় কাটে তাদের। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর স্ত্রী শিক্ষাবিদ ও লেখিকা আসমা আব্বাসী গত ৩ জুলাই রাতে মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

কারও জীবন সাত দশক ছুঁই ছুঁই অথবা পেরিয়ে গেছে আগেই। জড়িয়ে আছেন বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন দুয়ার। অবিশ্রান্ত কঠোর জীবন। এখনো তারুণ্যমাখা তাদের কথাবলা, পথচলা আর সৃষ্টিশীলতা। মঞ্চ-টিভি নাটক, সংগীত, চলচ্চিত্র, উপস্থাপনাসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় অনেকেই আছেন, যারা এখনো প্রাণচঞ্চল। সত্তরের কিছু বাকি আছে তার। তবু অসম্ভব ব্যস্ততা। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দেশব্যাপী। অভিনেতা ও উপস্থাপক হানিফ সংকেত ব্যস্ত রয়েছেন ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও প্রোডাকশন হাউজ ‘ফাগুন অডিও ভিশন’ নিয়ে। বললেন, ছিলাম প্রকৌশলী। অথচ মানুষ জানে ‘ইত্যাদি’র হানিফ সংকেত। আফজাল হোসেন চিরসবুজ। অসম্ভব ব্যস্ততা তার। সত্তর স্পর্শ করছেন। একগাল হেসে বললেন, ‘অভিনয় শুরু করেছি ১৯৭৫ সালে। শুধু অভিনয় করে কি পেট ভরে? লেখালেখি, আঁকাআঁকি, ব্যবসা, অভিনয় নিয়েই আছি। সব মিলিয়ে চলে যাচ্ছে...।’ এখনো সত্তরের ঘরে পা রাখেননি জননন্দিত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। অভিনয় যদিও কমিয়ে দিয়েছেন, লাবণ্য কিন্তু কমেনি এতটুকু।

নাটক নিয়ে জীবন পাড়ি দিচ্ছেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। থেমে নেই ৮৩ বছর বয়সেও। অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন যখন তিনি ক্লাস সিক্সে পড়েন। নাটক, লেখালেখি আর ব্যবসা নিয়ে তার ব্যস্ততা। একাত্তরের শব্দসৈনিক, ‘থিয়েটার’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ‘থিয়েটার’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘আবদুল্লাহ আল-মামুন থিয়েটার স্কুল’-এর অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি এ নাট্যব্যক্তিত্ব বললেন, ‘ভালোই চলছে। আছি; নিয়মিত কাজ করছি। যতদিন সুস্থ থাকি, এভাবেই চলবে। জানি না কতদিন সুস্থমতো কাজ করতে পারব।’ মঞ্চ ও টেলিভিশনের একসময়ের তুখোড় অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। ৭০ পার করেছেন। এখন আর অভিনয়ে নিয়মিত নন। তবু মঞ্চকাঁপানো এ অভিনেত্রী নাটকের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকেন। ইল্যুশনিস্ট জুয়েল আইচ। দেশে তো বটেই, বিদেশেও প্রিয়মুখ। একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুবকের মুখাবয়ব। ৭০ পার হয়েছে তার। বললেন, ‘ভালোই তো আছি। এই তো চলছে...।’ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললেন, ‘কত বয়স হয়েছে, না জানাই ভালো। তবে সত্তর পেরিয়েছি, হা হা হা...।’ চিরসবুজ আসাদুজ্জামান নূর। আতাউর রহমান, আবুল হায়াত, খায়রুল আলম সবুজ, তারিক আনাম খান, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, লাকী ইনাম প্রত্যেকেই ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্লান্ত নন জীবনসংগ্রামে।

৭৬ বছর বয়সেও মামুনুর রশীদের অভিনয় চলছে আগের মতোই। বিভিন্ন পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে লিখছেন নিয়মিত। নাটক, চলচ্চিত্র নিয়ে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই হাঁটছেন। ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের এ প্রাণপুরুষ অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘হ, অভিনয় করতাছি তো। এখনো শুটিংয়ে আছি। ক, কী বলবি?’ অন্যদিকে রয়েছেন ৭৫ বছর বয়সী অভিনেতা, লেখক, অনুবাদক খায়রুল আলম সবুজ। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চার সঙ্গেও জড়িত। অনুবাদ সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। নাট্যচক্রের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক প্রাইভেট কার চালাতে চালাতে বললেন, ‘আমি তো এখন শুটিংয়ে যাইতেছি। যতদিন সুস্থ আছি অভিনয় চলবে।’ আর ৭১ বছর বয়সী তারিক আনাম খান এখনো চুটিয়ে অভিনয় করছেন।

৭২ বছর বয়সী মঞ্চ ও টিভির একসময়ের জনপ্রিয় মুখ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান নাগরিক নাট্যাঙ্গনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা লাকী ইনাম বললেন, ‘এখনো আমি বাংলাদেশ বেতারের অতিথি প্রযোজক। একসময় টেলিভিশনে প্রচুর নাটকে অভিনয় করেছি। মঞ্চেও কাজ করছি, সেই ’৯৫ সাল থেকে।’

নাটক ও চলচ্চিত্রে একসময়ের জনপ্রিয় মুখ রাইসুল ইসলাম আসাদ। ৭১ বছর বয়সী এ দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা এবং অভিনেতা বললেন, ‘বোঝো না, বয়স হইছে তো! মাইনষে আগের মতো আর ডাকে না। না ডাকুক। আমি ভালো আছি। ঘুরছি, ফিরছি। বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াই। ইচ্ছে হলে কিছুমিছু করি। এভাবেই চলছে। এই আর কি, হা হা হা।’

মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক, ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলা, ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ হেসে বললেন, ‘কাজ করছি তো! নিয়মিত কাজ করছি। নতুন ছবির কাজ শুরু হবে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’

সংগীত জগতে রয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী, রুনা লায়লা, আবিদা সুলতানা, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা; মাত্র সত্তরে পা দেওয়া সাবিনা ইয়াসমীন। বাঙালির সম্পদ সুকণ্ঠী সাবিনা ইয়াসমীন হেসে বললেন, ‘ভালোই তো চলছে। সেই কবে থেকে গান করছি! একদম ছোটবেলায়, ১৯৬২ সালে গাওয়া শুরু করি। তখন আমার বয়স ৮ বছর। সেটা ছিল বাচ্চাদের গান। রবীন ঘোষের সুরে, “নতুন সুর” ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করি। ’৬৭ সালে, জহির রায়হানের “আগুন নিয়ে খেলা” ছবির মাধ্যমে বড়দের জন্য শুরু করি গান গাওয়া। এ পর্যন্ত গানের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। এখনো যদি কেউ আসে, কথা ও সুর পছন্দ হলে, গান গাই। এমনিতে গাওয়া হয় না।’

রয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম। বরেণ্য গীতি কবি মো. রফিকুজ্জামান এখনো গান লেখেন। খুরশীদ আলম জানালেন, গান করছি, থেমে নেই। যখন যেখানে যেমন করতে হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, রফিকুল আলম, অরূপরতন চৌধুরী এখনো সংগীত ছাড়েননি। গান করছেন ইচ্ছেমতো। রফিকুল আলম বললেন, ‘গান করছি তো! দেশ-বিদেশে আমন্ত্রণ পেলেই অনুষ্ঠান করছি। যতদিন সুস্থ আছি গান করব।’ ডা. অরূপরতন চৌধুরী বললেন, ‘সেই কবে থেকে গান চলছে! এখনো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে লাইভ অনুষ্ঠান করছি। যখন যেখানে যে ডাকে চলে যাই।’ হৃদয় হরণ করা হাসির চিরসবুজ কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ^জিৎ। গত বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি কানাডায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন তার সন্তান নিবিড়। এখন কিছুটা সুস্থ। কুমার বিশ^জিৎ বললেন, ‘একটু ধাতস্থ হয়ে নিই। আবার শুরু করব।’

ঢাকার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে এখনো অনেকে রয়েছেন, যারা সত্তরোর্ধ্ব। আগের মতো সেলুলয়েডে ব্যস্ত না থাকলেও, সুস্থ জীবনযাপন করছেন। রয়েছেন চিত্রনায়ক আলমগীর, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ববিতা, শাবানা, সুচন্দা। ঢাকাই চলচ্চিত্রের একসময়ের প্রবল জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা প্রায় সময়ই বিদেশে থাকেন। দেশে আসেন কখনোসখনো। কিন্তু মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন না। যেমনটি বলেন না আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা। অভিনয় এবং মিডিয়া থেকে দূরে রয়েছেন চিত্রনায়ক উজ্জ্বল। বললেন, ‘আর কত? সন্তান বড় হয়েছে না? মিডিয়ার বাইরেই থাকতে চাই।’ হাসতে হাসতে বললেন, ‘আর না। অনেক তো হলো!’

রয়েছেন পরিচালক কাজী হায়াৎসহ বেশ কয়েকজন প্রিয়মুখ। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ৭৫ বছর বয়সী কাজী হায়াৎ বললেন, ‘এখনো নিয়মিত কাজ করছি। মাত্রই একটা ছবির কাজ শেষ হলো।’ আছেন পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকবি, সুরকার, চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, চলচ্চিত্র সম্পাদক, চিত্রগ্রাহক, সংগীত পরিচালক ৭৬ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। তিনি বললেন, ‘৭৮ সাল থেকে পরিচালনায় আছি। এখনো কাজ করছি। সংলাপ, চিত্রনাট্য, গান, ক্যামেরা, লাইট, শট, এডিটিং আমার রক্তে। এসব ভুলি ক্যামনে?’

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রয়েছেন মোরশেদুল ইসলাম এবং তানভীর মোকাম্মেল। মুচকি হেসে মোরশেদুল ইসলাম বললেন, ‘এখনো কাজ করছি। করে যাব। “আগামী” দিয়ে শুরু করেছিলাম, জানি না কোন চলচ্চিত্র দিয়ে শেষ হবে।’ নৃত্যে রয়েছেন শামীম আরা নিপা। সত্তরোর্ধ্ব এ নৃত্যশিল্পী এখনো সমানতালে নেচে যাচ্ছেন। জড়িয়ে আছেন নৃত্য সংগঠনের সঙ্গে। নিজের নাচের স্কুল ‘নৃত্যাঞ্চল’ নিয়ে সারাক্ষণের ব্যস্ততা তার।

৭৪ বছর বয়সী চলচ্চিত্র গবেষক ও সমালোচক অনুপম হায়াৎ একগাল হেসে বললেন, ‘আমি তো সবসময় তরুণ। বয়স হচ্ছে বয়সের মতো। যখন সময় আসবে চলে যাব। তার আগে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পকে আরও উন্নত দেখতে চাই।’ আবৃত্তিতে রয়েছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা এখনো উদ্যমী। ৭৬ বছর বয়সী যাত্রানট, পালাকার, নাট্যকার মিলন কান্তি দে এখনো অভিনয়, লেখালেখি করছেন।

এমন কর্মক্ষম, চিরতরুণ প্রাণচঞ্চল মানুষদের দেখে আমরা আশাবাদী হই। বাঙালি সংস্কৃতির জগতে তারাই উত্তরসূরি রেখে যাবেন প্রিয় বাংলাদেশে। দেশপ্রেম, নান্দনিকতা আর সৃষ্টিশীলতা জড়িয়ে থাকুক তাদের। দীর্ঘজীবী হোক, বাঙালির অনন্ত অনুপ্রেরণার চিরতরুণ প্রিয় মুখদল।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত