গত ১৭ জুন তুরস্কের আন্তালিয়ার সকালটা বাংলাদেশের জন্য ছিল ভীষণ আনন্দের। সেদিন ১৮ বছরের এক তরুণ প্রত্যাশার বাইরে থেকে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেন। সেখানে চলছিল প্যারিস অলিম্পিকে সরাসরি খেলার কোটা অর্জনের চূড়ান্ত আসর। বিকেএসপির দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাগর ইসলাম রিকার্ভ এককের সেমিফাইনালে পৌঁছেই পেয়ে যান প্যারিসের টিকিট। প্যারিসগামীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যাচ্ছেন নিজ যোগ্যতায়। অধরা ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন নিয়ে প্যারিস গেছেন সাগর।
চার দশকের অলিম্পিক যাত্রায় বাংলাদেশের বারবার সঙ্গী হয়েছে পদক না পাওয়ার হতাশা। এবার সেই হতাশা পেছনে ফেলতে জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের অধীনে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন চা বিক্রেতা মায়ের সন্তান সাগর। ইতিহাস গড়ার কথাটা দেশত্যাগের আগে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন এভাবে, ‘আমি তৃপ্ত হব যদি নিজের সেরাটা দিয়ে খেলতে পারি। বিশ্বাস আছে, সেরাটা দিতে পারলে অবশ্যই আমার পক্ষে অনেক দূর যাওয়া সম্ভব এবং যেটা হয়নি, সেই ইতিহাস গড়াও সম্ভব।’
অলিম্পিক পদকের স্বপ্নের কথা সাগরের কণ্ঠে একটু বাড়াবাড়ি শোনালেও একেবারেই অসম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নকআউট পর্বের ম্যাচগুলোয় বেশ ভালো করছেন তিনি। হেসেখেলেই তিন সিরিজে ২৭-২৮ তুলে ফেলছেন; যা তাকে দেখাচ্ছে বড় স্বপ্ন। বিশ্বের সেরা ৬৪ জন তিরন্দাজ অংশ নেবেন এই ইভেন্টে। শুরুতে হবে র্যাংকিং রাউন্ড। যেখানে ভালো স্কোর পেলে শুরুতেই সেরাদের এড়ানো যাবে। ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৬৭২ স্কোর গড়া সাগর অবশ্য র্যাংকিং রাউন্ড নিয়ে সেভাবে চিন্তিত নন, ‘র্যাংকিং রাউন্ডের স্কোর নিয়ে চিন্তা করছি না। নিজের স্বাভাবিক স্কোরটা তোলার চেষ্টা করব। আমি আসলে নকআউট ম্যাচগুলোতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে এখানে যারাই খেলবেন, প্রত্যেকেই সেরা। সুতরাং কাজট অত সহজ নয়। র্যাংকিং রাউন্ড নিয়ে বেশি চিন্তা করলে দেখা যাবে নকআউট ম্যাচে মনোযোগ দিতে পারব না।’
অলিম্পিকের আবহটা অজানা তরুণ সাগরের। তাই প্রস্তুতি ক্যাম্পে কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ চেষ্টা করেছেন সেই আবহের কিছুটা তৈরি করে সাগরকে অনুশীলন করানোর। সাগর বলেন, ‘কোচ আমার জন্য টঙ্গীতে একটা ফাইনাল স্টেজ তৈরি করেছেন। সাধারণত অলিম্পিকের মতো ইভেন্টগুলোতে যে রকম আবহ থাকে, তিনি সে রকম একটা আবহে আমাকে এক সপ্তাহ অনুশীলন করিয়েছেন। শেষ কদিন যেভাবে প্র্যাকটিস করিয়েছেন, তাতে ভালো আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই যাতে নিজেদের সেরাটা দিতে পারি।’
অথচ কোটার প্রশ্নে সাগরে স্পটলাইট ছিল না। ভাবনার কেন্দ্রে ছিলেন হাকিম আহমেদ রুবেল। তা ছাড়া রিকার্ভ দলগত ইভেন্ট নিয়ে ছিল আশা। খুব কাছে গিয়েও রুবেলের মতো দলগত ইভেন্টে বাংলাদেশ পারেনি কোটা অর্জন করতে। সাগর নিজেই সে কথা বললেন, ‘কোটা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবার প্রত্যাশা ছিল দলগত ইভেন্ট নিয়ে। তবে খুব কাছে গিয়েও আমরা পাইনি। পরে এককে ভাগ্য সহায় ছিল বলে আমার হয়েছে। অন্য দুজন সতীর্থও (রুবেল ও রামকৃষ্ণ সাহা) কিন্তু অনেক ভালো খেলেছে।’
অনেক সংগ্রাম করে সাগরকে মানুষ করছেন মা সেলিনা। রাজশাহীর একটা টং দোকান চালিয়ে দুই সন্তানকে বড় করছেন সংগ্রামী এই নারী। মায়ের এই আত্মত্যাগ সাগরকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করছে। পাশাপাশি তিনি ভালো কিছু বয়ে আনতে চান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপি ও সেখানকার স্যারদের জন্য, ‘মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতেই যাব। এ ছাড়া বিকেএসপির কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। বিকেএসপির স্যারদের কারণেই আজ আমি এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি; বিশেষ করে বলব নূরে আলম স্যারের কথা। আমি অসচ্ছল পরিবার থেকে এসেছি। তিনি সব সময় আমার পরিবারের দিকটা দেখেছেন। কীভাবে সারা বছরের বেতন মওকুফ করা যায়, সেই চেষ্টাটা সব সময় করেছেন। এ ছাড়া আমি যে রিকার্ভ ইভেন্টে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করছি, এই ইভেন্টে তিনিই আমাকে প্রথম নিয়ে আসেন এবং প্রথম রিকার্ভটা তিনিই আমার হাতে তুলে দেন। বিকেএসপি আমাকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, বিদেশি কোচের কাছে খেলার শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। সেটা না করলে আমি জাতীয় দলেও আসতাম না, কোটা প্লেসও অর্জন করতে পারতাম না। বিকেএসপিতে থাকাকালে কোরিয়ান কোচ লি ইয়ং হোর কাছে খেলাটা শিখেছি বলেই জাতীয় দলে আসতে পেরেছিলাম। আসলে বিকেএসপিকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।’
টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি যোগ্যতা অর্জন করে খেলেছিলেন আরচার রোমান সানা। যদিও অল্পের জন্য সেরা ১৬-তে জায়গা করে নিতে পারেননি এই আরচার। অল্পের জন্য হেরে যান কানাডার প্রতিযোগীর কাছে। সাগর চান অগ্রজকে ছাড়িয়ে পদক ছুঁতে। সেটা হয়ে গেলে কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। খেলাটাই যে এমন। নিজের দিনে যে কেউ হতে পারেন সেরা। আগামীকাল ২৫ জুলাই শুরু হতে যাওয়া ইভেন্টের বাকি দিনগুলো সাগর নিজের মতো করে নিতে পারলেই হয়ে যাবে ইতিহাস।