জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরোধীকারী জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারণে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই ব্যক্তিকে তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে।
এর আগে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য তিনটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৪১ সালে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াত গঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত চারবার নিষিদ্ধ হলো।
দীর্ঘদিন ধরেই মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন মহল থেকে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এর আগে ২০১৩ সালে আদালতের আদেশে নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধ বাতিল হয়। এরপর দলটি তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় তা-ব চালানো হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৫৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সহিংসতা ও নাশকতায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবির জড়িত আছে বলে সরকারের মন্ত্রীরা দাবি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটির নেতাকর্মীরা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। ওই সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। আরও কয়েকজন নেতা কারাগারে বন্দি।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনি মতামত পাঠানোর পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন আর এই নামে রাজনীতি করতে পারবে না।
প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়েছে : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল।
এতে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২-এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত যেভাবে : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পরদিন মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বুধবার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হবে। ওইদিন সাত মন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। তবে সেদিন কোনো ঘোষণা আসেনি। গতকাল সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়।
নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার পর দলটির পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কয়েক বছর আগে সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হলেও পরে সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি।
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া : নিষিদ্ধের পর জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকারের নির্বাহী আদেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করায় তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সরকার ছাত্রদের অরাজনৈতিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য দেশে দলীয় ক্যাডার ও রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে গণহত্যা চালায়।’
জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলে মোকাবিলা : সচিবালয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি সরকারের আছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরও তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না।’
দলের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াত ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১-এর পর যারা জন্ম নিয়েছেন, তাদের বিচার করা হবে এরকম গণহারে বিচার করা হবে না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি : নিষিদ্ধের পর জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো সহিংসতা হলে তা দমনের সক্ষমতা সরকারের রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছি। ওদের বিরুদ্ধে আমরা সেই একাত্তর থেকে যুদ্ধ করছি। সুতরাং এগুলো দমনে আমাদের সক্ষমতা অনেক আছে।’
সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার : নিষিদ্ধ করার পর গতকাল বিকেল থেকে ঢাকাসহ সারা দেশেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশ। ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে ডিএমপি। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পুলিশ নিরাপত্তা জোরদার করেছে।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন মোড়ে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে পুলিশ। টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশের পুলিশ ও র্যাবকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদেরও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।