শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

৫-৭ লাখে ক্লিনার থেকে ইন্সপেক্টর, ঘুষের টাকা পেয়েছেন আতিকও

আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ এএম

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৪-এ ক্লিনার ছিলেন মো. নান্নু। তিনি এখন বিদ্যুতের ইন্সপেক্টর। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর তার মতো আরও সাতজন ক্লিনারকে বিদ্যুৎ বিভাগের ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই বছরের মে মাসে আরও ২৫ জন কর্মচারীকে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, এসব দায়িত্ব পেতে ঊর্ধ্বতন মহলে তদবির করতে হয়েছে কর্মচারীদের। যারা মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়েছেন, তারাই লাভজনক পদ পেয়েছেন। ঘুষের টাকা বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পৌঁছেছে মেয়রের দপ্তর পর্যন্ত। জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির সদ্য বিদায়ী মেয়র আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। লাভজনক পদ পাওয়া পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা কেউ টাকা দেওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার করেননি। তবে ভালো জায়গায় কাজের বিনিময়ে ‘খুশি’ হয়ে স্যারদের উপহার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকে।

সংস্থাটির অফিস আদেশে দুটি অদ্ভুত শর্তে এসব দায়িত্ব দেওয়া হয়। শর্তগুলো হচ্ছে এ আদেশে কর্মচারীরা পদোন্নতি দাবি করতে পারবেন না এবং পদায়নকৃত পদে স্থায়ীকরণের জন্য মামলা করতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের দাবি, তারা দীর্ঘদিন সিটি করপোরেশনে কাজ করছেন। এই অভিজ্ঞতার কারণে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেয়েও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তারা। লাভজনক পদ পাওয়া পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা কেউ টাকা দেওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার করেননি। তবে ভালো জায়গায় কাজের বিনিময়ে ‘খুশি’ হয়ে স্যারদের উপহার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকে।

গত বছরের ১০ মে ডিএনসিসির সচিব মাসুদ আলম সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে দেখা গেছে, অফিস সহায়ক, মালী, স্প্রে ম্যান, দারোয়ান, সহকারী মেকানিক এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার হেল্পারকে রাজস্ব শাখায় হিসাব সহকারী হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাষ্য, সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে লাভজনক দপ্তর রাজস্ব শাখা। সেখানে উপরি আয়ের সুযোগ বেশি। টাকা দিয়ে হলেও সবাই রাজস্ব শাখায় পদায়ন চায়। অফিস সহায়ক, ভ্যাকসিনেটর থেকে অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে অনেককে পদায়ন করেছে সংস্থাটি।

কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ক্লিনারের কাজ রাস্তা পরিষ্কার করা। তার কাছে করপোরেশনের ঝাড়ু থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা-সংক্রান্ত যান-যন্ত্রপাতি থাকে। ইন্সপেক্টরে র কাছে করপোরেশনের একটি মোটরসাইকেল ও ওয়াকিটকিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু থাকে। রাজস্ব বিভাগের হিসাব সহকারী পদে নিয়োজিত ব্যক্তির অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। এ কারণে টাকা দিয়ে হলেও এ দায়িত্ব নিতে চায় অনেকে।

সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের বাসভবন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন পারুল বেগম (ছদ্ম নাম)। প্রতিষ্ঠানের চৌকস ও বিশ্বস্ত কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে হিসেবে পারুলেরও আলাদা কদর পাওয়ার কথা। যখন সহকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছিল, তখন পারুলও তদবির করেছিলেন। এক কর্মকর্তার মাধ্যমে মেয়রের দপ্তরে কথা বলেছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ৫ লাখ টাকায় রফা হয়। তবে এ টাকা ম্যানেজ করতে না পারায় ‘ভালো কাজের’ দায়িত্ব তিনি পাননি।

মোহাম্মদপুর এলাকার এক প্রবীণ পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, তিনিও ‘লাভজনক’ কাজের কথা শুনেছেন। শ্রমিক নেতাদের মাধ্যমে মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু টাকার পরিমাণ শুনে সাহস পাননি। তিনি বলেন, ‘আমার এত টাকা ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। যাদের টাকা আছে, তারা দিয়েছে। এখন সে টাকা নানাভাবে উসুল করে নিচ্ছে।’

ডিএনসিসির সচিব (যুগ্ম সচিব) মাসুদ আলম সিদ্দিকী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সড়কবাতি সচল রাখার জন্য ইন্সপেক্টর প্রয়োজন ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। করপোরেশনের প্রয়োজনে মেয়রের ক্ষমতাবলে এমন দায়িত্ব দেওয়া যায়। বিভিন্ন দপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী অনেক পদে একইভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি বলেন, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।’

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। তার এমপিএস ফরিদ উদ্দিনের নম্বরটিও বন্ধ। 

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি সংস্থা প্রয়োজন মনে করলে কর্মচারীদের পদোন্নতি দিতে পারে, অতিরিক্ত দায়িত্বও দিতে পারে। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়ম মানা না হলে সরকারি যেকোনো কাজে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠা স্বাভাবিক। নিয়ম মানা হলেও অভিযোগ আসতে পারে। এগুলো আমাদের ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থার ফল।’

তিনি বলেন, ‘এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মানুষের আস্থা বা বিশ্বাসের কোনো জায়গা নেই। সব কাজেই সন্দেহজনক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। যে চাকরি পায় না, সে মনে করে টাকা দিলে চাকরি পাওয়া যাবে। এখান থেকে দেশকে বের করতে অনেক যুদ্ধ করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে পারলেই মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করবে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত