রাজধানী ঢাকা ও এর উপকণ্ঠের সড়কে প্রতিদিন চলাচল করে প্রায় ১৫ হাজার বাস। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব বাস থেকে প্রতিদিন ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জোর করে সমিতির নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। এরপর টানা ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক ছিল তার দখলে। পরিচিত ছিলেন সড়কের একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে। তার অনুমতি ছাড়া সড়কে নতুন কোনো বাস নামতে পারত না।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন বাস নামানোর অনুমোদনের নামে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিতেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। শুধু সড়কে চাঁদাবাজি করেই তিনি হাজার কোটি টাকার বেশি কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই টাকায় নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের নামে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট কেনার পাশাপাশি ব্যাংকে জমান বড় অঙ্কের টাকা। বিদেশেও তার রয়েছে বিপুল সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়া লিখিত অভিযোগে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কমিশনের উপপরিচালক নূরুল হুদা অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকা শহর ও শহরতলিতে চলাচলকারী প্রতিটি বাস থেকে সমিতির নামে প্রতিদিন ২০, টার্মিনাল সমিতির ৩০ এবং কমিউনিটি পুলিশের জন্য ১০ টাকাসহ মোট ৬০ টাকা আদায় করা যাবে। এর বেশি নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের লোকজন নির্দিষ্ট এই পরিমাণের চেয়ে বাসপ্রতি দিনে কয়েকগুণ বেশি টাকা আদায় করত। তার আমলে প্রভাব খাটিয়ে কত টাকা করে আদায় করা হয়েছে এবং সেসব টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে, তা এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে শুধুমাত্র।
সমিতির কয়েকজন নেতা বলেছেন, ঢাকার চারটি বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন প্রায় আট হাজার বাস চলাচল করে। এর মধ্যে গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে ১ হাজার ৮০০, সায়েদাবাদ থেকে ১ হাজার ৫০০, মহাখালী থেকে এক হাজার এবং গাবতলী থেকে তিন-চার হাজার বাস চলাচল করে। এ ছাড়া ঢাকার আরও কয়েকটি জায়গা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আরও কয়েকশ বাস চলাচল করে। সমিতির নিয়ম অনুযায়ী, এসব বাস থেকে দিনে ৬০ টাকা করে ১৫ বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু এর থেকে অনেক বেশি টাকা আদায় করেছে এনায়েত উল্লাহ সিন্ডিকেট।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, রাজধানী ও এর উপকণ্ঠের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ১৫ হাজার বাস থেকে প্রতিদিন ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা করে চাঁদা আদায় করত এনায়েত উল্লাহর সিন্ডিকেট। সে হিসেবে দিনে গড়ে ১ কোটি টাকা করে চাঁদা আদায় করা হলেও ১৫ বছরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছে।
সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এর পরপরই এনায়েত উল্লাহ পরিবহন খাত দখল নেন। ওই সময়ে তিনি বিএনপির একজন সাবেক মন্ত্রীসহ কয়েকজন পরিবহন নেতার গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। প্রশাসনকে ব্যবহার করে অনেকের গাড়ি রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ করেন। কেউ নির্দেশ অমান্য করে বাস সড়কে নামালে তার পেটুয়া বাহিনী লাঠি হাতে সেই বাসের সামনে দাঁড়িয়ে যেত। ঢাকার চারটি টার্মিনাল থেকে অনেক পরিবহন নেতার বাস বের হতো। একসময় তারা সেসব বাস বিক্রি করে দিতে অথবা রঙ ও নাম পরিবর্তন করে অন্যের কাছে ভাড়া দিয়ে দিতে বাধ্য হন।
এ প্রসঙ্গে পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এনায়েত উল্লাহ সড়কে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নামে নানা সময়ে সরকার থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকদের কল্যাণে কখনো কাজ করেননি। তার জন্য পরিবহন শ্রমিকরা নিয়োগপত্র পাননি। তার কাছে পুরো পরিবহন সেক্টর জিম্মি ছিল।’
ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-সিলেট সড়ক ছিল তার দখলে : পরিবহন সমিতির নেতারা বলেন, এনায়েত উল্লাহ তার ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিটি রুটে নিজের ৫০ শতাংশ বাস দিতেন। তবে কিছু রুটের পুরোটাই দখল নিতে চাইতেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পুরোটাই দখলে নিয়েছিলেন তিনি। একই অবস্থা ছিল ঢাকা-সিলেট সড়কেরও। যে কারণে সাধারণ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের রোষানলে পড়ার ভয়ে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপরই পালান এনায়েত উল্লাহ। এরপর থেকে বিক্ষুব্ধ অন্যান্য গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা এনা পরিবহনের বাস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করেন। তবে সড়ক পরিবহন সমিতির নেতারা বলছেন, সড়ক-মহাসড়কে এনায়েত উল্লাহ যে সামাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তার পতন হয়েছে, কিন্তু তার বাসগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করে এসব বাসের চেসিস ও ইঞ্জিন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। তাই এসব বাসের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায় সড়ক পরিবহন সমিতি।
পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা জানান, এনায়েত উল্লাহর ১ হাজার ৫০০ বাস থাকার কথা উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও বাস্তবে এত গাড়ি নেই। তার নিজের পরিবহন কোম্পানি এনা ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনে ৬০০-৭০০ এসি ও নন-এসি বাস থাকতে পারে। এর বাইরে আরও কয়েকটি কোম্পানিতে তার শেয়ার (মালিকানার অংশবিশেষ) আছে।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি জমা পড়ে কমিশনে। ওই অভিযোগে বলা হয়, রাজধানীর উপকণ্ঠের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ১৫ হাজার বাস থেকে প্রতিদিন ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে এনায়েত উল্লাহর সিন্ডিকেট। তিনি নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের নামে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট কেনার পাশাপাশি ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমিয়েছেন। এ ছাড়া, দেশের বাইরে পাচার করেছেন শত শত কোটি টাকা। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
জানা গেছে, এনায়েত উল্লাহ ও তার স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেন দুদকের উপপরিচালক নূরুল হুদা। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয় ও মেয়ে চাশমে জাহান আলাদাভাবে সম্পদের হিসাব দুদকে জমা দেন।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে এনায়েত উল্লাহ সম্পদের উৎস হিসেবে এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেড, সোলার এন্টারপ্রাইজ, এনা শিপিং এবং এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তানজিল ও বসুমতি পরিবহনে তাদের শেয়ার থাকার তথ্য উল্লেখ করেন। তিনি দুদকে দাখিল করা হিসাবে তারসহ পুরো পরিবারের মোট ২১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। তবে হিসাবে তার সম্পদের যে দাম দেখানো হয়েছে, তা বাজারদরের চেয়ে অনেক কম। তার সম্পদের প্রকৃত মূল্য ধরে হিসাব করলে তা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে স্থাবর ১৩ কোটি ৭৬ লাখ ও অস্থাবর ১৩৭ কোটি ১১ লাখ টাকার। স্থাবর সম্পদের মধ্যে রাজধানীর মিরপুরে ৮.২৫ বিঘা জমিতে ছয়তলা বাড়ি, যার মূল্য ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা; মিরপুরের মনিপুরপাড়ায় ৮ শতাংশ জমিতে ছয়তলা বাড়ি, মূল্য ৫২ লাখ ৫৭ হাজার; ধানমণ্ডির ১১ নম্বর রোডে ৬২ নম্বর বাড়ির ৪/এ নম্বরে ৩ হাজার ৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মূল্য ৩২ লাখ ৫০ হাজার; বসুন্ধরা সিটিতে ১৫১ বর্গফুটের একটি দোকান, মূল্য ২৪ লাখ ২৫ হাজার; দক্ষিণখানে ৭৮ শতাংশ জমি, মূল্য ২৯ লাখ ৩৬ হাজার; দক্ষিণখানে ১০ শতাংশ জমি, মূল্য ১ কোটি; কেরানীগঞ্জে ৪০ কাঠা জমি, মূল্য ৭৬ লাখ ২৫ হাজার; রূপগঞ্জে ১০ কাঠা জমি, মূল্য ৩ লাখ; গাজীপুরের দনুয়া মৌজায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার জমি এবং ফেনীতে ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ১২ শতাংশ জমি থাকার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেডের নামে ৮০টি বাস, যার মূল্য দেখানো হয় ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকায় চলাচলকারী তানজিল পরিবহনে ১ লাখ টাকার শেয়ার ও বসুমতি পরিবহনে ৫ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে বলে জানানো হয়। আর সোলার এন্টারপ্রাইজে আড়াই লাখ, এনা শিপিংয়ে ২০ লাখ ও এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানিতে ৮ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তার ব্যাংকে ৫৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকার এফডিআর এবং নগদ ৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জমা থাকার কথা জানানো হয়। তিনি বিয়ের সময় ২৫ ভরি স্বর্ণ উপহার পান।
স্ত্রী নার্গিস সামসাদের সম্পদ : নার্গিসের ৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকার স্থাবর ও ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্থাবরসহ মোট ১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দেন। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরায় ৩ কাঠার প্লট, যার মূল্য ১৫ লাখ টাকা; ধানম-িতে একটি ফ্ল্যাট, মূল্য ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা; সোলার এন্টারপ্রাইজে দেড় লাখ টাকার শেয়ার, প্রাইজবন্ড ও এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজে বিনিয়োগ ৪০ লাখ এবং এনা ট্রান্সপোর্টে ৬০ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। ব্যাংকে নগদ জমা ১ কোটি ১৭ লাখ এবং ১ কোটি ১৬ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। এ ছাড়া তার ধানম-ির একটি ফ্ল্যাটে ৫০ শতাংশ এবং মিরপুরের মনিপুরের বাড়িতে ৫০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ছেলে রিদওয়ানুল আশিকের সম্পদ : রিদওয়ানুল আশিকের স্থাবর-অস্থাবর মোট সম্পদ রয়েছে ৩০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার। এর মধ্যে স্থাবর সম্পদ ৮ কোটি ২৪ লাখ ও অস্থাবর সম্পদ ২২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার। তার এনা ট্রান্সপোর্টে ২০ লাখ টাকার শেয়ার, এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজে ৪০ লাখ টাকার শেয়ার, রাজধানীর গুলশানের ১২৯ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর বাড়িতে ৫ কোটি টাকার ৩ হাজার ২০০ বর্গফুটের ৪/এ নম্বর ফ্ল্যাট রয়েছে। রাজধানীর মিরপুরে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন স্থানে ১০৯ শতাংশ জমি, যার মূল্য ৩ কোটি টাকা এবং উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট রয়েছে, যার দাম দেখানো হয়েছে ৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া তার নামে ২১ কোটি ৯৬ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে।
মেয়ে চাশমে জাহানের সম্পদ : চাশমে জাহানের ৫ কোটি ১৮ লাখ টাকার স্থাবর ও ১১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার অস্থাবরসহ মোট সম্পদ রয়েছে ১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। তার গুলশানের ১২৯ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর বাড়িতে ৩ হাজার ২০০ বর্গফুটের ৫/এ নম্বর ফ্ল্যাট, যার মূল্য ৫ কোটি টাকা, বাড্ডার কাঁঠালদিয়ায় ৫ কাঠা ভিটি জমি, মূল্য ৩ লাখ টাকা এবং এনা ট্রান্সপোর্টে ২০ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে ৪২ লাখ টাকার (ঢাকা মেট্রো গ-১৫-২৫২৪) একটি গাড়ি রয়েছে।