দেশে আধুনিক গণপরিবহনের বহরে মেট্রোরেল যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো বড় অংশের যাত্রীদের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা বাসই। কিন্তু বছরের পর বছর এসব লক্কড়ঝক্কড় বাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়কে। ফলে যাত্রীদের ভোগান্তির যেন শেষই হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মাঝে মধ্যেই ঘোষণা দেয় লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধের। গত ১৯ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও জানিয়েছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে রাজধানীতে চলাচলকারী সব ধরনের যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করা না হলে, বিআরটিএর বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, দেশে বাসের সংখ্যা ৮৪ হাজার ২৯৬টির মতো। কিন্তু এর বাইরে অসংখ্য বাস চলছে যেগুলো অনুমোদন নেই।
গত বছরের জুনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে বলা হয়, বাসকর্মী-শ্রমিকরা মনে করেন, ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ বাসের নিবন্ধন, ২৪ শতাংশ বাসের ফিটনেস, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ বাসের ট্যাক্স-টোকেন এবং ২২ শতাংশ বাসের রুট পারমিট নেই। এর আগে ২০১৯ সালে বিআরটিএ আদালতকে জানিয়েছিল সারা দেশে ৩৩ শতাংশ গাড়ির ফিটনেস সনদ নেই। আর ৫৬ শতাংশ গাড়িতে নেই গতি নিয়ন্ত্রক সিল।
বছরের পর বছর ফিটনেসবিহীন বাস সড়কে চলায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় ছয়জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না। দুর্ঘটনার আগের দিন কোনোভাবে মেরামত করে বাসটি রাস্তায় নামানো হয়। শুধু এই ঘটনাই নয়, আরও অনেক বড় দুর্ঘটনার সময় দেখা যায় ফিটনেসবিহীন থাকায় এরকম দুর্ঘটনাগুলো হয়ে থাকে সড়কে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ফিটনেসবিহীন এসব লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধে ২০১২ সাল থেকে বিআরটিএ থেকে বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পরও সড়ক থেকে সরানো যায়নি এসব বাস। তাছাড়া গত বছরের এপ্রিলে তৎকালীন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানিয়েছিলেন, গত বছর ১ জুন থেকে ঢাকার সড়কে কোনো রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড় বাস চলাচল করতে পারবে না।
একই সঙ্গে রাজধানীর সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে। আর সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ইয়াসিন এক সভায় জানিয়েছে, চলতি বছর আগামী মে মাস থেকে সড়কে ফিটনেসবিহীন বাস চলতে দেওয়া হবে না। তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা এসব ঘোষণা কঠোরভাবে পালন না করলে ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিআরটিএ এসব বন্ধের সিদ্ধান্ত এক যুগের বেশি সময় ধরে শুনে আসছি। কিন্তু কখনো বন্ধ হয় না। এখন যদি উচ্ছেদ করে তাহলে একটি বাসের বদলে আরও দুটি বাস নামাতে হবে। কারণ আমাদের সিটিতে বাসের সংখ্যা খুবই কম। তাছাড়া বিআরটিএ এসব অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এখনো সড়কে বাসের সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে সংস্থাটি। তাছাড়া এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যাত্রীদের প্রতিনিধি থাকলে যাত্রীদের হয়ে কথা বলার সুযোগ থাকে। যাত্রীদের প্রতিনিধিরাই বাসে চলাচল করে। তাবে প্রকৃত সমস্যাটি জানে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম বলেন, আনফিট গাড়ি সড়কে চলাচল করুক আমরা চাই না। সরকার সড়ক থেকে আনফিট বাস সরিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তাছাড়া সমিতির পক্ষ থেকে বাস মালিকদের সঙ্গে আমাদের দফায় দফায় মিটিং হয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে তাদের কঠোরভাবে বলা হয়েছে, তারা যেন কোনোভাবে আনফিট গাড়ি সড়কে না চালায়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিআরটিএর প্রধান সমস্যা হলো তাদের জনবল ঘাটতি। এখনো তারা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করে। যার জন্য অনেক কিছু তারা চাইলেও পারে না। বিআরটিএ আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কয়েকটি কোম্পানিকে তাদের এসব কাজ দিতে পারে। সে কোম্পানিগুলোর কাগজ তারা মনিটরিং করবে। তাহলে এসব বাস বন্ধে সফলতা অর্জন করতে পারবে।