চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনি। ‘প্রায় শুদ্ধ’ জাপানে পোস্টিং পেলেই কেউ নিজেকে শুধরে নেন না। যেমন নেননি নুরুল ইসলাম। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম জাপানের নারিতায় গিয়েছিলেন স্টেশন ম্যানেজার হিসেবে। সেখানে গিয়েই নানা অনিয়ম শুরু করেন। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন স্থানীয় বিমানের জিএসএ (জেনারেল সেলস এজেন্ট) প্রতিষ্ঠানপ্রধান। অভিযোগ পেয়ে পরদিনই তাকে প্রত্যাহার করে বিমান। যেখানে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত হওয়ার কথা। দোষী প্রমাণ হলে শাস্তি হওয়ার কথা বিধি অনুযায়ী। এসব কোনো কিছুই করা হয়নি। উল্টো তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় ৮৮ দিনের মাথায়।
যাত্রীরা ৩০ কেজি বা একটা নির্দিষ্ট ওজনের মালামাল বহন করতে পারেন। এর বেশি হলেই অতিরিক্ত মাশুল দিতে হয়। দুনিয়া জুড়ে এ নিয়ম মানা হয়। কিন্তু মানা হয় না বিমানে। নানা কায়দাকানুন করে বিমানে অতিরিক্ত পণ্য বহন করা হয়। এর জন্য যাত্রীরা মাশুল দিতে প্রস্তুতি নিয়েই এয়ারপোর্টে যান। সেখানে যাওয়ার পরই যাত্রীদের কানে কানে স্টেশন ম্যানেজার বা তার প্রতিনিধি বলেন, ‘এত টাকা মাশুল দেবেন কেন। আমাকে বরং অর্ধেক দিন। তাতে আপনারই লাভ। আর আমারও কিছু থাকল।’
যাত্রীদের সঙ্গে এই দফারফা করতে করতে ফ্লাইট ছাড়তে বিলম্ব হয়ে যায়। যারা নিয়ম মেনে বিমানে ভ্রমণ করতে চান, তারা বিরক্ত হন এবং পণ করেন আর বিমানে না ওঠার। আর সময়মতো যাত্রা করতে না পারায় বিমানকে জরিমানা গুনতে হয়। এভাবেই সুনাম নষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনসের।
নারিতা স্টেশন ম্যানেজার হয়ে নুরুল ইসলাম প্রকাশ্যেই যাত্রীদের সঙ্গে তাদের অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ নিয়ে দরকষাকষি করতেন। জাপানে বিমানের জিএসএ ওয়েস্টার্ন অ্যাসোসিয়েটসের তোমোইচি ওনিশি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানান, নুরুল ইসলাম শুধু মাশুল ছাড়াই যাত্রী উঠান না, তিনি নারীর হাত ধরে টানাটানি করেন। বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এরিয়ায় ঢুকে পড়েন যখন-তখন।
নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওয়েস্টার্ন অ্যাসোসিয়েটস অভিযোগ করে গত ৪ মার্চ। পরদিন ৫ মার্চই তাকে প্রত্যাহার করে বিমান। এরপর অভিযোগগুলো যথাযথ তদন্ত না করেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতির আদেশ জারি করে গত ৩০ জুন। ওইদিন ২৩ জন সহকারী ব্যবস্থাপককে উপসহকারী ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম রয়েছেন ১০ নম্বরে।
উপব্যবস্থাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মোবাইল ফোনে দফায় দফায় চেষ্টা করেও তার নাগাল পাওয়া যায়নি। টানা এক সপ্তাহ চেষ্টার পর তাকে পাওয়া যায়। তিনি ফোন ধরলেন। তবে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর কথা বলতে চাননি। পরে যোগাযোগ করার কথা বলে লাইন কেটে দেন।
এর মধ্যেই তিনি বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি এক জায়গায়। পরে কথা বলব।’ রিপোর্টারের জবাব, আপনি পরেও কথা বলবেন না। তাই ব্যস্ত থাকলেও একটু কথা বলুন। এ বিষয়টাও আপনার জন্য জরুরি। নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করেন রিপোর্টার কোন বিষয়ে কথা বলতে চান।
জাপানের নারিতা বিমানবন্দরে বিমানের স্টেশন ম্যানেজার হিসেবে থাকাকালে আপনি নানা অনিয়ম করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কথা বলার মতো অবস্থায় আমি নেই। পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।’ পরে আর কথা বলেননি। এমনকি মেসেজ দিলেও সাড়া দেননি নুরুল ইসলাম।
বিমানের জিএসএ ওয়েস্টার্ন অ্যাসোসিয়েটসের তোমোইচি ওনিশি বিমানের এমডিকে বলেন, ‘বিষয়টি ব্যক্তিগত আক্রমণ হতে পারে, এই উদ্বেগের কারণে তিনি সমস্যাগুলো নিয়ে রিপোর্ট করা থেকে বিরত ছিলেন। বিমানকে সমর্থন জোগাতে আমাদের কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। পরিশ্রমী কর্মীদের মন ও মান রক্ষার স্বার্থে এই প্রতিবেদন লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের এই কর্মীরা প্রায়ই দেখেন নুরুল ইসলাম বিমানযাত্রীরদের কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছেন। বেশি ওজনের জন্য চার্জ আরোপ না করে তাদের ছাড় দিচ্ছেন। ১০ হাজার ইয়েন (জাপানি মুদ্রা) নিয়ে যে ব্যাগেজ ছেড়ে দিচ্ছেন, তার চার্জ হতো ৫০ হাজার ইয়েন। আমরা গড় করে দেখেছি, তিনি মাসে ১০ দিন এভাবে বেশি ওজনের মালপত্র পার করে দিচ্ছেন। এতে বিমান স্থায়ীভাবে রাজস্ব ও আস্থা হারাচ্ছে। আমাদের স্থানীয় সব কর্মী বুঝতে পারেন এটা অপরাধ। এতে বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে। কিন্তু নুরুল ইসলাম এ অপকর্ম করেই যাচ্ছেন।’
জিএসএ একটি স্টেশনে এয়ারলাইনসের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে সিভিল অ্যাভিয়েশন-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সাপোর্ট দেয় জিএসএ। ওয়েস্টার্স অ্যাসোসিয়েটসের তোমোইচি ওনিশি বিমানের এমডিকে আরও বলেন, ‘নুরুল ইসলাম বিমানের পাইলট বা ক্যাপ্টেনের দেওয়া কুকিজ, চীনাবাদাম ও অন্যান্য খাবার নিয়ে বিমান থেকে খেতে খেতে বের হন এবং রেসস্ট্রিকটেড জায়গায় গিয়েও খান। আমার কর্মীরা তাকে বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। কিন্তু তিনি পাত্তাই দেন না। বিমান সম্পর্কিত বহিরাগতদের নুরুল ইসলামের কক্ষে প্রবেশের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। নুরুল তার অফিসে একজন বাংলাদেশি নারীকে নিয়ে আসেন। তাকে দেখে মনে হতো সে যেন এয়ারপোর্টেই কাজ করে। স্টেশন ম্যানেজার আমাদের দেওয়া পাস ব্যবহার করে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করেন। তিনি এপাশের অপব্যবহার অব্যাহত রাখলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের সবার পাস বাতিল করে দিতে পারেন। এসব বিষয়ে আমরা খুবই বিব্রত।’
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নুরুল ইসলাম ওয়েস্টার্ন অ্যাসোসিয়েটসের স্টাফদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে চেয়েছেন তার ওজনে কারচুপির কথা কে জিএসএ প্রধানকে জানিয়েছেন। নুরুল প্রতিনিয়ত নারীদের ছবি তোলেন। তিনি বন্ধুত্বের অসিলায় আমাদের নারী স্টাফদের শরীর স্পর্শ করেন। জাপানিরা এসব হয়রানির বিষয়ে খুবই প্রতিক্রিয়াশীল। এ বিষয়ে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়ে তার সতর্ক থাকা উচিত।
তিনি আমাদের কর্মীদের অবজ্ঞা করে বললেন, তোমরা সবাই নোংরা, আবর্জনা বা আবর্জনার চেয়েও খারাপ। আমি ভয় পাচ্ছি স্টাফরা যদি এসব বিষয় অভিবাসন বিভাগ বা থানায় অভিযোগ করেন, তাহলে আমরা গুরুতর সমস্যায় পড়ে যাব। আমাদের কর্মীরা মানুষ হিসেবে নুরুলের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন। অনেকে তার সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকার করেছেন।
বিমানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, বিমানের বিদেশি স্টেশনে অনিয়মের ঘটনা শুধু জাপানেই হচ্ছে বিষয়টি এমন না। কানাডার টরন্টো, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ভারতের দিল্লি, কুয়েতসহ আরও কয়েকটি স্টেশনেও হয়েছে। এখনো অনেক স্টেশনে হচ্ছে।