বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ডিএসসিসি

তাপস-খোকনের প্রকল্পে সিরাজের দুর্নীতি

  • ভুয়া সনদে ছাত্রলীগ নেতাকে প্রকৌশলী নিয়োগ
  • আবেদনের শর্ত ভেঙে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে
  • আ. লীগ আমলে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পান
  • সিগন্যাল বাতি না লাগিয়েই ৩৮ কোটি টাকা লোপাট
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৫ এএম

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষাগত সনদে তিনি স্থাপত্যবিদ হলেও ২০ বছর ধরে তিনি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব পালন করছেন। তার নিয়োগে ও পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় নানা অসঙ্গতি রয়েছে।
 
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিরাজুল ইসলাম ডিএসসিসির অন্তত ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। এসব প্রকল্পে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন নগর প্রশাসন। তৎকালীন সরকার দলীয় দুই মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও সাঈদ খোকনকে ম্যানেজ করে বারবার পার পেয়ে গেছেন তিনি। এমনকি নকল সনদে ছাত্রলীগের এক নেতাকে প্রকল্পের প্রকৌশলী নিয়োগ দিলেও সে ব্যাপারে নিরব ছিল ঢাকা দক্ষিণের নগর প্রশাসন।

ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালের নাম করে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের অন্তত ৩৮ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ভুল পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকারি টাকার ও সময়ের অপচয় করেছেন তিনি। 

যেভাবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ

ইউক্রেনের খারকভ ইনস্টিটিউট থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ডিপ্লোমা পাশ করেন সিরাজুল ইসলাম। তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) বিজ্ঞপ্তি ও তফসিলে উল্লেখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি স্থপতির চাকুরি পান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থপতি পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চায় ডিসিসি। সিরাজুল ইসলাম ডিপ্লোমা অর্জনের ৩ বছর ৫ মাস ২১ দিন পর স্থপতি পদে যোগ দেন। এতে প্রজ্ঞাপন ও তফসিলের ব্যতয় ঘটে। ২০০৪ সালে তৎকালীন ডিসিসি এক অফিস আদেশে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় সিরাজুল ইসলামকে। ২০১১ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আলাদা হলে ওই অফিস আদেশটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। নতুন আদেশ ছাড়াই ২০ বছর ধরে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদে আছেন স্থপতি সিরাজুল ইসলাম। 

২৭০০ কোটি টাকার প্রকল্পের পরিচালক

আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হওয়ায় বড় বড় প্রকল্পে সিরাজুল ইসলামকে দায়িত্ব দিয়েছেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ও ব্যারিষ্টার তাপস। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্প (২০১৫-২০২৩), প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্ট-ডিসিএনইউপি (২০০৯-২০১৪), ৮০০ কোটি টাকার নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প- কেইস (২০০৯-২০১৪) এবং প্রায় ৮ কোটি টাকার ইন্টিগ্রেটেড মাস্টার প্ল্যান ফর ঢাকা (২০২০-২০২৩) প্রকল্পের পরিচালক করা হয় তাকে। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে তিনি একই সময়ে ৩টি বড় প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সিরাজুল ইসলাম ডিএসসিসির নগর পরিকল্পিনা বিভাগকে স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছেন। ডিএসসিসির মতো শীর্ষ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে নগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনায় তার কোনো অংশগ্রহণ নেই। পরিকল্পনাবিদের চেয়ারে বসে প্রকল্পের সরকারি টাকা লোপাট করেছেন। 

জাল সনদে ছাত্রলীগ নেতাকে প্রকৌশলী নিয়োগ

ডিএসসিসির অনুন্নত এলাকার উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্টে (ডিসিএনইউপি) পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংস্থাটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামকে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভুয়া সনদ দিয়ে পল্টন থানা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিষয়টি জানাজানি হলে তৎকালীন প্রশাসন ওই প্রকৌশলীকে অব্যহতি দেয়। কিন্তু সিরাজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

ডিসিএনইউপি প্রকল্পে আরও দুর্নীতি

সম্প্রতি এক ঘটনার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে লিখিত বিবৃতি দেন সংস্থাটির তৎকালীন প্রকৌশলী আশিকুর রহমান। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ডিসিএনইউপিতে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালকের পদ নিয়ে দুর্নীতির মচ্ছব করেন সিরাজুল ইসলাম। কাজ না করার পরও ডিএসএম কনসালটেন্টকে অতিরিক্ত ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিল দিয়েছেন দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন তিনি। আরও ১৭ কোটি টাকার বিল পরিশোধের সব ব্যবস্থা করেন তিনি, যা প্রধান প্রকৌশলীর হস্তক্ষেপে রক্ষা পায়।’

ট্রাফিক সিগন্যালের ৩৮ কোটি

ঢাকা শহরের পরিবেশের মান উন্নয়নের জন্য হাতে নেওয়া হয় নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প। বিশ^ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট এ প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পটির ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ অংশের শেষ দিকের পরিচালক ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি প্রকল্প পরিচালক থাকার সময়েই ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালসহ প্রকল্পের বিভিন্ন পার্ট ক্লোজ হয়। 

অভিযোগ উঠেছে, কেইস প্রকল্পের পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ তৈরীর নামে ৩৮ (আটত্রিশ) কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সিরাজুল ইসলাম। অথচ ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়নি, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এখন আনসারদের বেডরুম। 

পরিকল্পনায় জালিয়াতি

মহা পরিকল্পনা করার নাম করে নিজের ঘনিষ্ঠ স্থপতির প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আড়াই কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২০২১ সালের ২৪ জুন দক্ষিণ সিটি এলাকার সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ডিএসসিসি। শুরুতে মেয়াদকাল এক বছর হলেও পরে সময় বাড়ায় সংস্থাটি। মেয়াদকাল শেষে কারিগরি কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। কারিগরি কমিটি ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তাদের শাস্তির সুপারিশ করে। 

উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনার কাজে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে স্থাপত্যের কাজের জন্য নেওয়া হয়। মূল কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থাপত্যের কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটি। 

সে পরিকল্পনায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাকে অচল হিসাবে দেখানো হয়। কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বাণিজ্যিক জোন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, সড়ক ব্যবস্থপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘ সময় নিয়েও প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কারিগরি কমিটির সদস্যরা। তারা বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার দায় প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম এড়াতে পারে না। তার ঘনিষ্ঠ একজন স্থপতির প্রতিষ্ঠানকে মহাপরিকল্পনা (২০২০-২০৫০) তৈরীর নামে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অবৈধভাবে পরিশোধ করেন তিনি। 

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য সিরাজুল ইসলামের দপ্তরে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে কল দিলেও রিসিভ করেননি।

ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে সংস্থাটির সচিব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিএনসিসির প্রধান নগর পরিকল্পবিদও স্থপতি। করপোরেশন চাইলে যে কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে পারে এবং সংস্থা যতদিন চাইবে ততদিন তিনি এ পদে থাকতে পারবেন।’ 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত