শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

১৮২ নিখোঁজের পরিচয় খুঁজতে স্বরাষ্ট্রকে নির্দেশ

আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৬ এএম

গত ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের রূপসী এলাকায় গাজী অটো টায়ার কারখানায় দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে নিখোঁজ রয়েছেন ১৮২ জন মানুষ। চার মাস পরও বলা হচ্ছে না এই মানুষগুলো মৃত না জীবিত। মৃত হলে মরদেহগুলো কি ছাই হয়ে গেছে? আর জীবিত থাকলে তারা কোথায়? ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও

দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করতে রাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা কর্তৃক অধিকতর তদন্ত করতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। একই সঙ্গে নিখোঁজ ১৮২ জনের পরিচয় চূড়ান্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

গাজী অটো টায়ার কারখানায় আগুনের ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও তদন্ত কমিটির গণশুনানিতে মোট ১৮২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির ঠিকানা মিলেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে আলাদা আলাদা চিঠিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, খুব দুঃখজনক সত্য যে, ১৮২ জন মানুষ নিখোঁজ, আসলে তাদের হয়তো পুড়িয়েই মেরে ফেলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনায় আমরা শুনেছি খুব ছোট ছোট মানব দেহের খন্ড খন্ড হাড় পাওয়া গেছে কারখানার পোড়া অংশে। এসব ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনার খুব ভালো তদন্ত হওয়া উচিত। অন্তত মানুষগুলোর পরিবারকে দ্রুত আশ্বস্ত করা উচিত, নিখোঁজদের আসলে কী ঘটেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তদন্তের। আশা করা যায়, তারা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিষয়টি তো খুবই মর্মান্তিক, যে একরকম বলা হচ্ছে তারা বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের কোনো মরদেহ নেই।’

অক্টোবর মাসের শেষের দিকে গাজী অটো টায়ার কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনার সঠিক তথ্য নিশ্চিতের গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক এই প্রতিবেদন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পাঠানো এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানাটির কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ তালিকায় নেই। ১৮২ জন কারা বা কেন এই কারখানায় এসেছেন, তা বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। তদন্ত করে নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামে সচল থাকা মোবাইল নম্বরগুলো উদ্ধার ও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। পরে উদ্ধার করা হাড় ও মাথার খুলি স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে। প্রতিবেদনে এটিও দাবি করা হয়েছে, কোনো বৈদ্যুতিক বা গ্যাসের কারণে এ আগুনের ঘটনা ঘটেনি।

রূপগঞ্জের কারখানায় আগুনের ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো তদন্তাধীন। মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে কারখানা পাহারার দায়িত্ব দেয়। কয়েকদিন পর পাহারা ইস্যুতে দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। একটি পক্ষ পাহারার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে। এতে কারখানা কর্তৃপক্ষ অস্বীকৃতি জানায়। এরপর হুমকি দিয়ে গত ২৫ আগস্ট তারা কারখানা ত্যাগ করে।

গাজী টায়ার কারখানার মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী (সাবেক সংসদ সদস্য) গ্রেপ্তার হওয়ার খবর মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পরে গত ২৫ আগস্ট এলাকার লোকজন আনন্দ মিছিল বের করে। বেলা সাড়ে ১১টায় খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদ (খাঁ পাড়া) থেকে ঘোষণা আসে বিকেল ৩টায় রূপসী মোড় ও খাদুন মোড়ে জড়ো হওয়ার জন্য। একপর্যায়ে লুটপাটের উদ্দেশ্যে দুষ্কৃতকারীরা দুপুর ১২টায় কারখানায় প্রবেশ করে প্রায় ১৮০ জন শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারখানা থেকে বের করে দেয় এবং লুটপাট শুরু করে। বিকেল সাড়ে ৪টায় আরেক দল দুষ্কৃতকারী কারখানায় প্রবেশ করে লুটপাট চালাতে থাকে। পরে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দুষ্কৃতকারীরা একাধিক দলে ভাগ হয়ে বিকেলে কারখানার মধ্যে লুটপাট করতে থাকলে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাজী অটো টায়ার কারখানার ষষ্ঠ তলাবিশিষ্ট একটি পাকা মিক্সিং ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, অধিক পরিমাণে দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে ভবনটিতে ২১ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপণ করা হয়। ভবনে আগুন লাগার পরে ১০-১৫ জন ব্যক্তি দ্রুত বের হয়ে পালিয়ে যায়। ভবন থেকে পরে কোনো মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। তবে ১ সেপ্টেম্বর ভবনের ভেতর থেকে দেহের বিভিন্ন অংশের ১৫ খন্ড হাড় পাওয়া যায়।’

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য বুয়েট টিম ও নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের প্রতিনিধিরা সরেজমিনে ফায়ার সার্ভিসের টিটিএল এবং ড্রোন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর পরিদর্শন করেন। ভবনের চার ও পাঁচতলার ছাদ ধসে তিনতলার ওপর পতিত হয়েছে এবং কলামগুলো ফেটে গেছে। আরসিসি পিলার, বিম ও ছাদের ঢালাই খসে পড়েছে। ইটের দেয়ালগুলো বাঁকা হয়ে হেলে পড়ে গেছে। ফলে ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। যে কারণে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি।’

এদিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা এখনো নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন স্বজনদের খোঁজ পেতে। গত ২৯ ডিসেম্বর তারা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ করেছেন। পরিবারের নারী ও শিশুরা নিখোঁজদের ছবি হাতে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করে রাখেন। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাফর সাদিক চৌধুরীর আশ্বাসে তারা অবরোধ প্রত্যাহার করেন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত