এই মুহূর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানবজাতির সবচেয়ে শক্তিশালী একটি সম্পদ। উন্নত অ্যালগরিদম এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে এআই অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান পরিস্থিতি
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের জলবায়ু সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই শতাব্দীর মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। জাতিসংঘ এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) মতে, ২০২৩ সাল ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। ডব্লিউএমও প্রধান সেলেস্তেসাউলো বলেন, ‘এটি পৃথিবীর জন্য একটি অশনি সংকেত।’
বিশ্বনেতারা প্যারিস চুক্তির অধীনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন, তা বর্তমানে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এর মধ্যেও এআই ও অন্যান্য প্রযুক্তি নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। জাতিসংঘ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এআইকে ‘ট্রান্সফরমেটিভ’ প্রযুক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনে এআই-এর ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলছে। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত উন্নতি আমাদের এই সংকট মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন নতুন পথ খুলে দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের ‘ইউনাইটেড ইন সায়েন্স’ প্রতিবেদন এ বিষয়টিকে আরও একবার সামনে তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।
এআই আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরও সঠিক, দ্রুততর এবং সহজলভ্য করে তুলতে সাহায্য করছে। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়ে ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণকে সহজতর করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিশাল পরিমাণ তথ্য কম সময়ে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। এআই-এর মাধ্যমে কোনো বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। জলবায়ুর ধরন ও পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্বাভাস ও বিশ্লেষণ করতে যে জলবায়ু মডেলগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর জটিল ও বৃহৎ পরিসরের গাণিতিক সক্ষমতা প্রয়োজন। এআই এই মডেলগুলোর কার্যকারিতা ও নির্ভুলতা বাড়াতে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণ করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাস এবং মডেলিং উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জলবায়ুর ধরন ও পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্বাভাস ও বিশ্লেষণ করতে যে জলবায়ু মডেলগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর জটিল ও বৃহৎ পরিসরের গাণিতিক সক্ষমতা প্রয়োজন। এআই এই মডেলগুলোর কার্যকারিতা ও নির্ভুলতা বাড়াতে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণ করে। এ ছাড়া, এআই বিভিন্ন তথ্য, যেমন জলবায়ু বিপত্তি, পরিকাঠামোগত দুর্বলতা এবং সামাজিক কারণে জড়িত ডেটার বিশ্লেষণ করে বন্যা, খরা বা অন্যান্য জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এই তথ্য দুর্যোগ প্রতিক্রিয়ার পরিকল্পনা উন্নত করা, স্থিতিস্থাপক পরিকাঠামো নির্মাণ এবং অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য কৌশল নির্ধারণে ব্যবহার করা যায়।
এআই জলবায়ুবিদ্যা সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য দেবে। চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি যেমন ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ বা ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিতে পারে এবং বাস্তুতন্ত্র ও বিভিন্ন স্থানের মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়নে সহায়ক হয়। ফলে, এটি বৈশ্বিক ও স্থানীয় স্তরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। জলবায়ু মডেল, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত চিত্র, আবহাওয়ার ধরন এবং বিগত সালের তথ্যাদি বিশ্লেষণে থাকবে এআই-এর ভূমিকা। এসব তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবহাওয়ার ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আরও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে মানুষ।
সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির মতো পুনর্নবীকরণ বা নবায়নযযোগ্য শক্তির সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, শক্তির চাহিদা এবং গ্রিড অপারেশন সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই শক্তি ব্যবস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াবে। ফলে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হয়ে উঠবে। এআই ব্যাটারি এবং শক্তি সংরক্ষণ ব্যবস্থাগুলোর চার্জিং ও ডিসচার্জিং প্রক্রিয়াকে উন্নত করবে। শক্তি সঞ্চয়ের কার্যক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ের দিকে নিয়ে যেতেও সক্ষম এআই। ব্যাটারি এবং শক্তি সংরক্ষণ ব্যবস্থা যত উন্নত হবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণও ততটা কমবে। ফলে পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এআই মানুষের সম্পদ ব্যবস্থাপনার বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব কমাতে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষিক্ষেত্রে এআই ব্যবহৃত হতে পারে, যেখানে সেন্সর এবং তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফসলের পরিচালনাকে উন্নত করা, জল এবং রাসায়নিক ব্যবহারে সূক্ষ্মতা অর্জন করে বর্জ্য হ্রাস করা হবে। স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থায়ও এআই ব্যবহৃত হতে পারে, যা যানবাহনের চলাচলের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে, যানবাহন থেকে কার্বন গ্যাস নিঃসরণ কমাবে এবং লজিস্টিক ও সরবরাহ চেইনকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করবে। ফলে পরিবহনব্যবস্থাই হয়ে উঠবে আরও কার্যকরী। এআই প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন অরণ্য, সমুদ্র এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল মনিটরিং এবং রক্ষণাবেক্ষণেও সহায়তা করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এআই স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে বন উজাড় চিহ্নিত করতে পারবে। অবৈধ উপায়ে মাছ ধরার তৎপরতা শনাক্ত করতে পারবে। এটি সার্বিকভাবে বাস্তুতন্ত্রের অবস্থা মূল্যায়ন করতে সক্ষম। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) তাদের ন্যাশনাল কার্বন প্রজেক্টের মাধ্যমে ভারতের অরণ্যের মানচিত্র তৈরি ও নিরীক্ষণের জন্য এআই ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ ও অপসারণের পরিমাণ নিরীক্ষণ করা এবং প্রমাণভিত্তিক অরণ্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়েছে। উপকূলীয় ক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ধরন বিশ্লেষণ করতে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো এবং মানুষের জীবনরক্ষার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা আরও সহজ করে তুলবে। এআই কার্যকর জলবায়ু নীতি গঠন এবং বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে বলে বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদরা মনে করেন। এটি কার্বন গ্যাস নিঃসরণ, অর্থনৈতিক সূচক এবং সামাজিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করবে। ফলে, নীতিনির্ধারকরা বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যয়, সুবিধা এবং ভারসাম্য বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এ ছাড়া, প্যারিস চুক্তির অধীনে এআই স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ এবং রিমোট সেন্সিং ব্যবহার করে জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে। রিমোট সেন্সিং হলো বস্তুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না করে কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। শব্দটি সাধারণত পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সম্পর্কে তথ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ নাগরিকদের পরিবেশ রক্ষায় আরও সচেতন এবং সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে এআই থেকে পাওয়া তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। এআই-চালিত প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নাগরিকরা তথ্যের সুবিধা পাবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত উদ্যোগে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজও করতে পারবেন। এআই পরিবেশগত তথ্যের রিয়েল-টাইম মনিটরিং এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তির ক্ষমতায়নেও ভূমিকা রাখবে। যার ফলে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলো শনাক্ত করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারকেও দায়ী করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া, এআই সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণের জলবায়ু সম্পর্কিত মতামত, মনোভাব এবং আচরণ বিশ্লেষণ করতে পারবে। যা সমাজের মনোভাব সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যের খনি হবে। আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র, আবহাওয়ার পরিবর্তন, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কে অসাধারণ যে তথ্য ও জ্ঞান আছে এআই সেগুলো নিয়েও কাজ করবে।
সাবধানতা ও সচেতনতা
এআই এবং প্রযুক্তির সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে চ্যালেঞ্জ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালানোর জন্য প্রচুর ডেটা এবং শক্তির প্রয়োজন হয়। এটি বড় কম্পিউটার এবং তথ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা অনেক সময় কার্বন নিঃসরণ বাড়াতে পারে। তথ্যের যথাযথ ব্যবহার, তথ্যের গোপনীয়তা এবং পক্ষপাতিত্ব কমাতে এআই পরিচালনা করতে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। এআই থেকে অর্জিত সুবিধাগুলো সবাই সমানভাবে পাচ্ছে কি না, সেটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলো এই প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য এআই এবং দেশজ বুদ্ধিমত্তার সম্মিলিত ব্যবহার ভবিষ্যতের সমাধানের পথ দেখাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং সঠিক পরিকল্পনা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করেছে। তবে এই প্রযুক্তি যথাযথভাবে ব্যবহার না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং স্থানীয় জ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটানোর মাধ্যমে আরও কার্যকর ও ন্যায়সংগত পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সবাইকে থাকতে হবে সজাগ।