বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

কৃষি ও কৃষি রসায়ন শিল্পে অগ্রাধিকার খাত উপেক্ষিত

আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৬ এএম

স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের বেশি সময় পরও আমরা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, গণমানুষের যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বড় ধরনের আশার সঞ্চার হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি যদি সুপার হাইওয়েতে পৌঁছে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে, তাহলে আধুনিক এক বাংলাদেশ হবে। আর যদি অর্থনীতিতে গতি আনতে না পারি, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সঙ্গে টিকতে না পারি তাহলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসবে। আর পারলে দেশে উৎপাদিত পণ্য, ইন্ডাস্ট্রি, স্থানীয় শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প মোদ্দা কথা এই দেশ হবে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ।

আমরা একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। ফলে এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা, সিভিল ব্যুরোক্র্যাট, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের জন্য। এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকের দায়িত্বশীল আচরণের মধ্য দিয়েই দেশকে একটি সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে হবে। যে সমস্ত শিল্পকলকারখানা ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে সুনামের সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে, তার মধ্যে আমাদের পোশাক শিল্প ও কিছু স্থানীয় উৎপাদিত শিল্প রয়েছে। আমরা ওষুধ শিল্প নিয়ে স্বপ্ন দেখি। এই শিল্পে যেহেতু প্রযুক্তিগত বিষয়টা ইতিমধ্যে রপ্ত করতে পেরেছি, ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করতে পেরেছি, ফলে এই শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা গেলে এই শিল্পে ভবিষ্যতে অনেক বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে এবং আমদানির বিকল্প ওষুধ আমাদের দেশেই উৎপাদিত হবে।  ওষুধ, পোশাক এবং অন্যান্য কিছু শিল্প যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে, ঠিক তার বিপরীত অবস্থানে রয়েছে কৃষিশিল্প। যেহেতু আমরা কৃষিতে গতিশীলতা আনতে পারিনি, ফলে আমদানির বিকল্প পণ্যগুলো আমদানিতেই রয়ে গেছে এবং কৃষকের উৎপাদিত পণ্য শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। মূলত কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে অবহেলিত বলেই ‘কৃষিশিল্প’ আজ অনগ্রসর।

কৃষকের উৎপাদিত পণ্য শিল্পে স্থানান্তর করতে পারিনি বলে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের একবার মূল্য পায়, একবার পায় না। আবার ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে যে সমস্ত উপকরণের প্রয়োজন হয়, সেগুলো আমাদের আমদানি করতে হয়। অথচ দেশের ৩৮ ভাগ শ্রমশক্তি কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত। যারা দরিদ্র, শ্রমজীবি কৃষক। এই জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই, তাহলে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। শিল্প উন্নয়ন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করতে হয়। যে কোনো দেশের কৃষিই যদি সেই দেশের জন্য উপযোগী হয়, তাহলে কৃষিকে ঘিরেই সে দেশের শিল্প গড়ে ওঠে এবং শিল্পের পরিবর্তে একটি সেবা খাত গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষি খাত অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। অন্যদিকে কৃষির পরিবর্তে আমাদের আমদানি ও ট্রেডিং বিজনেস, ইন্ডাস্ট্রিকে বাইপাস করে আমরা ট্রেডিং বিজনেসের দিকে চলে গেছি এবং এর ফলে ইন্ডাস্ট্রি না থাকার কারণে, এটা সেবা খাতের দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে না। এখানে শ্রমজীবী মানুষরা এমন কাজ করছে, যেখানে তার কোনো ইনকাম হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় ছোটখাটো দোকানপাট, মুদি দোকান, সিকিউরিটি গার্ড, সেলসের লোকজন, বিউটি পার্লার ইত্যাদি গরিব শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অথচ ব্যাপক শিল্পায়ন, কৃষিভিত্তিক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়ালসহ অন্যান্য সেক্টর যেমন রড, সিমেন্ট, পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ভিন্ন শিল্প কলকারখানা, যেমন- হতে পারে অটোমোবাইল, শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিসহ আরও অসংখ্য অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে শিল্পায়ন।

কৃষিতে যেসব সমস্যা আছে সেগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলোকে সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ ওষুধ ও কৃষি এই দুই শিল্পেই এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার  কারণে আমাদের পেটেন্টমুক্ত যে সুবিধা আছে, সেই এগ্রিমেন্ট আনুযায়ী এগ্রোকেমিক্যালসকেও এই পেটেন্ট রয়্যালটি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এই পেটেন্টের সুবিধা নিয়ে আমরা পেটেন্টভুক্ত যে কোনো কৃষিপণ্য এখানে উৎপাদন করতে পারি। উল্লেখ্য, ওষুধ শিল্পেও এই সুবিধা প্রযোজ্য। আমাদের দেশের শ্রমবাজার যেহেতু এখনো এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম দামে শ্রমিক পাওয়া যায়, পোশাক শিল্পের মতো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষিভিত্তিক অথবা এখানকার স্থানীয় যে সমস্ত কাঁচামাল আছে যেমন চামড়াভিত্তিক অথবা আমাদের দেশের যে সমস্ত কাঁচামাল এখানে এভেইলেবল আছে যেগুলো আমরা কখনো চিন্তাই করিনি, সেগুলোকে দিয়ে আমরা বিশ্ববাজারে যাওয়ার মতো পণ্য এখান থেকে উৎপাদন করতে পারি। 

আমাদের দেশের শিল্প-কলকারখানার গবেষণার মূল জায়গাটাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমির যে সংযোগ, তা আমরা করতে পারিনি। এটা শিল্পায়নের ক্ষেত্রে একটা চরম ব্যর্থতা। পৃথিবীতে ন্যানো টেকনোলজির জয়জয়কার। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে? এই মুহূর্তে কৃষির যে সমস্ত অগ্রাধিকার খাত আছে সেগুলোকে জরুরি শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে, এমনভাবে অ্যাট্রাক্টিভ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করেন। ভর্তুকি দিয়ে এই শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের দেশের কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং আমদানির বিকল্প প্রত্যেকটা সেক্টরে ইন্ডাস্ট্রি করে তারপর সেবা খাতে যেতে হবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল মেনুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন 

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত