মানুষ বলতে শুরু করেছে হত্যা, খুন, ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। জিনিসপত্রের দামও কমেনি, বরং বেড়েছে। তাহলে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা কী দোষ করেছিল? হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্ত কি তবে বৃথা গেল? ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন কী হচ্ছে না এই প্রশ্নের উত্তর আছে কিনা, তা আমার জানা নেই। গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর সংস্কার অপরিহার্য। সংস্কার কমিশনগুলো যে প্রস্তাবনা প্রদান করেছে, তা যদি রাজনৈতিক দল ও সরকারের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে গৃহীত হয়, তবে তা বাস্তবায়ন করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। গণতান্ত্রিক সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। এটি সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে কাজ করে এবং জনগণের চাহিদা, দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী অগ্রসর হয়। নির্বাচন ছাড়া কোনো সরকার প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধি হতে পারে না। নির্বাচিত সরকারই সংস্কার বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। কারণ তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে। অনির্বাচিত সরকার সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারবে না, কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচন, যা জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। নির্বাচন ব্যতীত কোনো সরকার জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারে না। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন না হলে, তা অবৈধ শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারে যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের অধিকার ক্ষুন্ন করে। তারেক রহমান নির্বাচন চাচ্ছেন মূলত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংস্কার বাস্তবায়ন এবং স্বৈরাচার প্রতিরোধের জন্য। তিনি বলেন, সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বৈধ নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। অনির্বাচিত সরকারের অধীনে সংস্কার কার্যকর করা সম্ভব নয়। নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে এবং দেশের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য এটি বিপজ্জনক হবে। তারেক রহমান দ্রুত নির্বাচন চান, যাতে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হয় এবং প্রকৃত সংস্কার বাস্তবায়িত হয়। তিনি মনে করেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো সংস্কার কার্যকর হতে পারে না এবং এটি দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা, জনগণের অধিকার, সমাজের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য কাজ করছে। দলটি ‘ভিশন-২০৩০’ এবং ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব প্রকাশ করেছে, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। তারেক রহমানের মতে, সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রথম শর্ত হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন যা জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। বিএনপি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাবে।
সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপির অঙ্গীকার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব, যা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি। তারেক রহমান আশঙ্কা করে বলেছেন, সংস্কারের আলোচনা যত বেশি দীর্ঘ হবে, দেশ তত বেশি সংকটে পড়বে। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয় এবং কেবল সংস্কারের আলোচনা চলতে থাকে, তাহলে স্বৈরাচার আবারও সুযোগ পেয়ে যাবে দেশের মানুষের কাঁধে চেপে বসতে পারে। সংস্কারের বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে যাদের জনগণ দায়িত্ব দেবে, তারা সংস্কারের কাজ শুরু করবেন। যত দ্রুত নির্বাচন হবে, দেশের সমস্যাগুলোর সমাধানও তত দ্রুত শুরু হবে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারই সমস্যার জট খুলে সেগুলোর সমাধান করবে। বিএনপি সবসময় সংগ্রাম করে সংস্কারের কথা বলেছে, কিন্তু সেই সময় অনেকেই সাহস করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। এখন যারা সংস্কারের কথা বলছেন, তাদের মুখে সেই সময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কোনো কথা শোনা যায়নি। ‘সংস্কার নাকি নির্বাচন’ এই প্রশ্নটি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কূটতর্ক। বিএনপি এবং দেশের সব দেশপ্রেমিক মানুষ বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কার এবং নির্বাচন উভয়ই প্রয়োজন। সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করতে গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টেকসই করতে নির্বাচন অপরিহার্য। গণতন্ত্রকামী জনগণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম অবশ্যই হাতে নেওয়া উচিত, কিন্তু জনগণের দুঃখ-দুর্দশা উপেক্ষিত রেখে কোনো সংস্কার সফল হতে পারে না। বিএনপি গণতান্ত্রিক উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে। যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তারা জনগণের কাছে ওয়াদা করবে যে তারা সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। মানুষের আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, কৃষকের জন্য পানি সরবরাহ সহজ করতে হবে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। কোনো আপস নেই, দেশে নির্বাচন হতেই হবে। জাতীয়, স্থানীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো পর্যায়ে যেখানে নির্বাচন হওয়া উচিত, সেখানে নির্বাচন হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর, কোনো ঝড়-বৃষ্টি বা তুফান যাই হোক না কেন, নির্বাচন হতে হবে। জনগণ যেহেতু ভোটার, তাই তাদের নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন হলে তা দেশের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। যদি জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হতেন, তবে তারা জনগণের জন্য কাজ করতে বাধ্য হতেন। কারণ তারা জানতেন, জনগণের সমস্যার সমাধান না করলে পরবর্তী নির্বাচনে হেরে যাবেন। তারেক রহমান নিশ্চিত করেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ সংকট থেকে মুক্ত হতে পারে, তবে এটি একদিনে হবে না। নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার আস্তে আস্তে সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করবে এবং যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তারা জনগণের কাছে ওয়াদা করবে যে তারা সংস্কার বাস্তবায়ন করবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তা গভীর সংকটের দিকে এগোচ্ছে। সরকারের ব্যর্থতা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। নির্বাচনের সংস্কার, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমনসহ বেশ কিছু সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দিলেও সরকারের অঙ্গীকারহীনতা ও সময়ক্ষেপণ জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। ছয় মাসে সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। মাজারে হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ এবং অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন সরকারের ব্যর্থতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অযোগ্যতা ও সরকারের দুর্বল নেতৃত্বের ফলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি যা সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি এবং মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্য দেশের অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে। অথচ সরকার এসব নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। এর ফলে সাধারণ জনগণ, বিশেষত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, যা সাধারণ মানুষের জীবিকা, জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ড. ইউনূস সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো তারা এখনো সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে সক্ষম হয়নি। জনগণ একটি সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রত্যাশা করছে। কিন্তু সরকার কেবল বিভ্রান্তিকর ও অর্ধসমাপ্ত বক্তব্য দিয়ে জনগণকে হতাশ করছে। জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি নির্বাচন নয়, এটি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি নতুন দিনের স্বপ্ন, যেখানে গণতান্ত্রিক ও সুশাসিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই বাংলাদেশ গড়ার জন্য এখনই সময় এসেছে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং রোডম্যাপ প্রকাশের যা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ও সফল জাতির ভিত্তি স্থাপন করবে। এটি কোনো বিলম্ব নয়, বরং একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নের মূল বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে