নাগরিকদের যেসব মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের পূরণ করার কথা, চিকিৎসা তার মধ্যে অন্যতম। নাগরিকরা কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পাবেন তা নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রের চিকিৎসা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা খাত কতটা উন্নত ও গণমুখী তার ওপর। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নাগরিকের চিকিৎসাব্যবস্থা শোচনীয়। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই, এমনকি মধ্যবিত্তের জন্যও তেমন সুযোগ নেই। ফলে আমাদের দেশে শুধু মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্তরাই যে বিদেশে চিকিৎসাসেবা নেন তা-ই নয়, মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশও জটিল রোগের চিকিৎসায় বিদেশে পাড়ি জমান। বলা হয় যে, মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তে যেতে হলে একটা হাসপাতালের বিলই যথেষ্ট। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকেই অর্ধশতকের বেশি সময়ে কোনো আমলেই জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়নি।
আশার কথা, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারে গেলে এই নিশ্চয়তা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) আদলে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের রূপরেখা প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, আগামীতে জনগণের ভোটে ক্ষমতাসীন হলে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা আজও নিশ্চিত হয়নি; চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানসম্পন্ন শিক্ষাও রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় নেই। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়ার কাক্সিক্ষত সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্য সাধারণ জনগোষ্ঠীর বিদেশে যাওয়ার প্রবণতায় এখনো রয়েছে উচ্চহার। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অদ্যাবধি সর্বজনীন জনবাস্তবতা হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার এ কথা আজও কাক্সিক্ষত মাত্রা পায়নি।’
আমাদের স্বাস্থ্য খাত ও সেবার শোচনীয় পরিস্থিতি মোটা দাগে প্রকট হয়ে ধরা দেয় করোনা মহামারীকালে। একদিকে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যেমন কঠিন, অন্যদিকে রয়েছে লুটপাট। করোনার আগে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন এবং এ বাবদ বিদেশে ব্যয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই মনে হয়। এই অবস্থা বুঝিয়ে দেয় যে, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা প্রকট। ফলে বিএনপির প্রতিশ্রুতি একটি আসার আলো হয়ে এসেছে। মোশারফ বলেছেন, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতিমালার (ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ) আলোকে বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখার ২৬তম ধারায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী বিএনপি উন্নত কল্যাণকামী রাষ্ট্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার আলোকে সবার জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেবে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এনএইচএস বা এ জাতীয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার আলোকে সবার জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ বিএনপি বলছে, ক্ষমতায় গেলে দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও বিস্তৃত করা হবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশের কম হবে না। প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর এবং পল্লী স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা করা হবে। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা এবং শিক্ষা ও গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অধিকাংশ সময়েই কথার কথা হয়ে থেকেছে। বেশিরভাগ সময়েই জনগণ তাদের কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। কিন্তু আর একবার স্বৈরাচার পতনের পর মানুষ নতুন আসায় স্বপ্ন দেখছে। আশা করি, বিএনপি স্বাস্থ্য খাতে তার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাবে। স্বাস্থ্যের মতো সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিতে পারলে এই আন্দোলন শুধু বৃথা যাবে না, বাংলাদেশের রাজনীতিও পুরনো নষ্ট চক্রেই ঘুরপাক খেতে থাকবে।