শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে

গদ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের আখ্যান

আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৫ এএম

আধুনিক যুগের অন্যতম বাহন হলো গদ্য। ইউরোপীয় সংসর্গ, জীবন বাস্তবতা, মানসিক টানাপড়েন, যুক্তিবোধ প্রকাশের জন্য গদ্যের প্রয়োজন ছিল। বলা হয়, শব্দই ব্রহ্ম, শব্দই জগৎ, শব্দই চৈতন্যে অধিষ্ঠিত শক্তি। সৃষ্টি বা মহাপ্রলয় শব্দের মধ্য দিয়ে হবে। মানুষ তো বটেই, সব প্রাণীরই নিজস্ব ভাষা আছে। আমরা শব্দসমুদ্রে বাস করছি প্রাচীন ও মধ্যযুগ পদ্যের, গদ্যের যাত্রা শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতকে, এই যাত্রা জলের মতো, অতল থেকে আছড়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত মানুষের চৌকাঠে, অগাধ ও অবাধে। সেসব শব্দজলের বিকীর্ণ কল্লোল, কালগ্রন্থি খুঁড়ে খুঁড়ে বাংলা গদ্যের এই উচ্চগ্রাম, তথা রূপের স্বরূপ অন্বেষণ এবং আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করেছেন ফয়জুল ইসলাম। কথাসাহিত্যে অভূতপূর্ব ও দিব্যোজ্জ্বল চিহ্ন রাখা এই মানুষটির লেখা ‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’ একটি হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল, যা আকরগ্রন্থ ও সহায়ক গ্রন্থের তালিকা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। ৭৩টির মতো বই নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করে, একাধিক মানুষের সাহচর্য ও পরামর্শ নিয়ে খটোমটো গদ্যে নয়, প্রাণোচ্ছল ও স্বতঃস্ফূর্ত কাহিনির চমৎকারিত্ব ও ভাষার শিল্পিতশৈলীতে সব ধরনের পাঠককে মুগ্ধ করার মতো করে তিনি বইটি লিখেছেন। বাংলা গদ্যচর্চার দীর্ঘ ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত আমলে নিয়ে, জটিল ও একপেশে ব্যাখ্যা পেরিয়ে ফয়জুল ইসলাম সাবলীল ভাষায় সেটি উপস্থাপন করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়েছেন। ফ্ল্যাপের ভাষায়, ‘বইটি বাংলা গদ্যচর্চার ইতিহাসে দিব্যদ্যুতিময়।’

‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’ বইটি গদ্যের বিস্তারিত ইতিহাস নয়, গদ্যভাষার অনুসন্ধান। বইয়ের সূচি দেখলেই তা অনুধাবন করা যায়। উপক্রমণিকার পর ‘রামরাম বসু : হাঁটতে শেখার সময়’,  ‘উইলিয়াম কেরি : সরল গদ্যভাষার সূচনা’, ‘মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার : বাংলা ভাষার প্রথম শক্তিশালী গদ্য’, ‘রামমোহন রায় : ঋজু হলো বাংলা গদ্যভাষা’,  ‘প্যারীচাঁদ মিত্র : গণমানুষের মুখের ভাষার কাছে’, ‘ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যভাষার মুক্তি’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : আরও ঋজু, আরও সহজ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলা গদ্যভাষার হাজার দুয়ারী’ প্রবন্ধগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে ফয়জুল ইসলাম সুমনের দীর্ঘ সাধনার।

বইয়ের শুরুতে সনৎকুমার সাহার একটি অনবদ্য ভূমিকাসহ নয়টি প্রবন্ধ প্রমাণ করে এটি লেখকের রীতিমতো গবেষণাধর্মী বই। তথ্যরাশির প্রতিস্থাপন, নিরাসক্ত ও আতিশয্যহীন বিচার-বিশ্লেষণে বইটি পাঠ-আনন্দের, তৃপ্তিরও। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকের গদ্যভাষা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এদের বাইরেও আরও অনেকে আছে। তাদের অবদান উল্লিখিত মনীষীদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। কখন কাকে কোথায় নিয়ে রাখবে তা কেউ জানে না। তা না হলে একজন মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, একজন রামরাম বসুর কথা আমরা কয়জনে জানি, আলোচনায় আনি! কিংবা একজন অবাঙালি উইলিয়াম কেরির যে অবদান তা তৎকালীন কোনো বাঙালির ছিল না। ফয়জুল ইসলাম এসব জায়গাগুলো উচ্চকিত করেছেন। তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ ইতিহাসবেত্তাগণের বাইরে যাননি, বরং সবার ভিন্ন বা অভিন্ন মতামতকে মত্থন করে দেখিয়েছেন বাংলা গদ্যের উৎপত্তির রূপবিন্যাস ও পথপরিক্রমা।

১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরুণ ইংরেজ কর্মচারীদের জন্য বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার ‘উদ্দেশ্য ছিল দুটো প্রথমত, বিদ্যার্থীদের বাংলা কথ্য ভাষা শেখানো; দ্বিতীয়ত, তাদের সমাজের রীতি-নীতি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেওয়া।’ এ কাজে নিয়োজিত পণ্ডিতগণ মধ্যযুগের সাহিত্যভাষার গৌরবময় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে সংস্কৃতমুখর, সুষমাবর্জিত, প্রাঞ্জলতাহীন, অসহজ, কখনো বা মেদবহুল, অনুন্নত এক গদ্যভাষা তৈরি করেন। কারণ, তারা কেউ জাতে সাহিত্যিক ছিলেন না, তারা পয়সার বিনিময়ে পাঠ্যপুস্তক রচনায় নেমেছিলেন। তারা মনে করতেন, বাংলা কোনো উচ্চামার্গীয় ভাষা নয়, এটা সংস্কৃতের বিকলাঙ্গ রূপ মাত্র। আর এ সময়ই রামরাম বসুর হাতে লিখিত হয় বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১)।’ এ বইয়ের সামগ্রিক অবয়ব, প্রভাব ও প্রেষণার জায়গাগুলো লেখক তুলে ধরেছেন। কীভাবে ‘লিপিমালা (১৮০২)’-এর গদ্যে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কমে ভাষা সংহত, সমকালীন সংস্কৃতাশ্রয়ী গদ্যের হাল্কা প্রভাবযুক্ত হয় তারও যৌক্তিক উপস্থাপন আছে। লিপিমালা রচনাকালে রামরাম বসু ভাষা নিয়ে সচেতন ও সংশোধনবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

সরল গদ্যভাষার সূচনা হয় উইলিয়াম কেরির হাতে। তিনি ধর্মপুস্তক ও ব্যাকরণ লেখেন, যা দীর্ঘদিন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পড়ানো হতো। ‘কথোপকথন’ (১৮০১) ও ‘ইতিহাসমালা’(১৮১২) গ্রন্থ দুটিতে বাংলা গদ্যের আদিমুখ দেখতে পাওয়া যায়। প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্যকর্মে তার প্রভাব লক্ষণীয়। আজকের সাহিত্যে যে নিচুতলার সংলাপ দেওয়া হয়, তার সূচনা করেছিলেন উইলিয়াম কেরি, ভাবা যায়!

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছিলেন উইলিয়াম কেরি ও জে. সি মার্শম্যানের সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত, সংস্কৃত, বাংলা ও ফারসিতে ছিল সমান দক্ষতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের গভীরতার কারণে সেই সময়ে প্রবাদসম লেখকের সম্মান পেয়েছিলেন। সংস্কৃতিরীতি, সাধুরীতি ও কথ্যরীতিতে তিনি মোট পাঁচটি গদ্যপুস্তক রচনা করেন। পণ্ডিতি সংস্কৃত গদ্যরীতি নয়, সরল সাধু গদ্যরীতির সফল প্রয়োগ এবং সাধু গদ্যভাষাতে কথ্য রীতির পুরোধা ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। লেখকের ভাষায়, ‘উইলিয়াম কেরি অন্ত্যজজনের যেসব কথোপকথন লিপিবদ্ধ করে গেছেন সেখানে আভিধানিক সংস্কৃত এবং আরবি-ফারসি নামশব্দ, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। উইলিয়াম কেরি যেন হাতড়ে হাতড়ে লাগসই খাঁটি বাংলা শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না; তাই আশ্রয় নিচ্ছেন আভিধানিক সংস্কৃত এবং আরবি-ফারসি শব্দসম্ভারের! অন্যদিকে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার সংলাপ রচনা করার সময় তেমন করে আরবি-ফারসি বা অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ খুঁজতে যাননি; তিনি যেসব শব্দকে কাজে লাগিয়েছেন সেগুলোর বেশিরভাগই লৌকিক ঘরানার শব্দ!’ তার হাতেই সর্বপ্রথম জড় বাংলা গদ্য প্রাণ পায়।

সাধু ভাষায় তিন ধরনের গদ্য লিখেছেন রাজা রামমোহন রায় শাস্ত্রীয়, মননশীল ও শিক্ষণীয় গদ্য। তিনি বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন। তিনি সাহিত্যিক হতে চাননি, যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হতে চেয়েছিলেন। বাংলা ভাষা, পণ্ডিতরা যাকে ‘শূদ্রের ভাষা’ বলে অচ্ছ্ুৎ বানিয়ে রেখেছিলেন, সেই শূদ্রের ভাষা’র উন্নত ব্যবহারই রামমোহন রায়ের পয়লা কৃতিত্ব। দ্বিতীয় হলো, গদ্যভাষায় ঋজুতা নিয়ে আসা। সংস্কৃত পদবিন্যাসহীন বিষম অনুপাতের সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার কমিয়ে সুদীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদ পরিহার করার ফলে একটি শৃঙ্খলা আসে বাংলা গদ্যভাষায়, যদিও ছন্দ এবং যতির অভাবে তার গদ্য খটোমটো রয়ে যায়। রামমোহন রায় আর মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের মধ্যে সমন্বয় বিধান করেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার আগ পর্যন্ত ছিল পণ্ডিতি সাধু ভাষার সংস্কারের ইতিহাস, যার পেছনে তৎকালীন সাময়িক পত্রাদিরও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। এ সময় লিখিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮), বাংলা উপন্যাসের মুখচ্ছবি, যা ছিল ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায়য়ের গদ্যের চেয়েও কলানৈপুণ্যে ভরপুর। যদিও সাধু ভাষার কথ্যরূপের পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন পাওয়া যায় ‘নববাবুবিলাস’ (১৮২৫)। তবে লৌকিক শব্দপ্রয়োগ, বাগধারা ও অভিব্যক্তি এবং বড় বাক্যের বদলে ছোট ছোট বাক্যের সহজ, সরল ও গতিময় বৈশিষ্ট্যে আলালের ঘরের দুলাল এগিয়েছিল। এ জন্যই কথ্য ভাষানির্ভর সহজ-সরল সাধু ভাষার প্রশংসা করতে গিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাকে বলেছেন ‘চলিত ভাষার বই লেখার এক রকম আদিগুরু।’

তবে বাংলা গদ্য এই পর্যায়ে আসার পেছনে বিদ্যাসাগরের অবদান বেশি। তার গদ্যভাষার কতটুকু বোধগম্য ও কতটুকু সর্বজন-ব্যবহার্য তার যথাযথ ব্যাখ্যা ও উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন লেখক। তার বিচিত্র গদ্যভাষার গতিময় বুনিয়াদের ওপরেই রঙ চড়িয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সাহেবি গদ্য ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অসাহিত্যিক পণ্ডিতদের সৃষ্টিছাড়া গদ্যচর্চার ত্রুটি সংশোধন করে সহজ-সরল মধুর গদ্যভাষা প্রবর্তন করে।

ওজনহীন সংস্কৃত শব্দ ও তদ্ভব শব্দের মেলবন্ধনে গদ্যে গতিময়তা আনয়ন এবং ছন্দের বিধান নিশ্চিত করে কাব্যিকতা ও শ্বাসাঘাতের ঝোঁক বুঝে বিরামচিহ্নের ব্যবহার শুরু করেন। বাঙালির এক চিরবিস্ময়ের নাম ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তার গদ্যের প্রভাব এখনো সমানভাবে বিদ্যমান।

কিন্তু আলালি ভাষা বা ঈশ^রীয় ভাষা, কোনটা গ্রহণ করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? নাকি দুটোই গ্রহণ করেছেন? এ প্রশ্নদ্বয়ের গভীরে গিয়ে কথা বলেছেন লেখক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘বঙ্কিম শিক্ষিত ব্যক্তির সকল প্রকার ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত করে তুলেছিলেন অনাদৃত বাংলা ভাষাকে।’ এটা সর্বদিক দিয়ে সত্য। তার গদ্যে আকাক্সক্ষা, সৌন্দর্য, প্রেম, রোমান্স, ভক্তি, মহত্ত্ব, স্বদেশানুরাগ বিপুলভাবে শব্দচাতুর্যে মহিমান্বিত হয়েছে। সর্বজনের ব্যবহারোপযোগী ঈশ্বরচন্দ্রের গদ্যকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে, দৃপ্ত পদক্ষেপে সমুখে এগিয়ে নিয়েছিলেন বঙ্কিম।

ঈশ্বর-বঙ্কিমের গদ্যেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও সহজ-সরল, নমনীয়, অলংকারধর্মী আর কাব্যিক করে তোলেন। এটা কীভাবে, কোন লেখায়, কেমন সময় নিয়ে করেন তার যৌক্তিক তথ্যসমৃদ্ধ ব্যাখ্যা আছে।

সুকুমার সেনের মতে, ‘মূলত তিনটা পর্যায়ে গদ্যের রচনাভঙ্গি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল, ‘জ্ঞানাঙ্কুর-ভারতী’ পর্ব, ১২৮৩ থেকে ১২৯০ বঙ্গাব্দ (প্রথম পর্ব); ‘হিতবাদী-সাধনা-ভারতী-বঙ্গদর্শন-প্রবাসী’ পর্ব, ১২৯১ থেকে ১৩২০ বঙ্গাব্দ (মধ্য পর্ব) এবং ‘সবুজপত্র-প্রবাসী-বিচিত্রা’ পর্ব, ১৩২১ থেকে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ (শেষ পর্ব)।’

প্রমথনাথ বিশী ও বিজিতকুমার দত্ত রবীন্দ্র রচনাশৈলীর যে যুগবিভাজন করেছেন তা সুকুমার সেনের কাছাকাছি। প্রথম জীবনে লেখা গদ্যে ক্রিয়াপদ, বিশেষ্য ও বিশেষণের সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য লক্ষণীয়। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট-এ অধিক হারে তদ্ভব ক্রিয়াপদের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, ফিরে গেছেন বঙ্কিমী সহজ-সরল গদ্যভাষায়, তবে পুরোপুরি নয়। এ উপন্যাসের সঙ্গে ঘাটের কথা গল্পের সাদৃশ্য বিদ্যমান কথ্য ও লৌকিক ক্রিয়া, তবে সংস্কৃতঘন ক্রিয়াপদের সংখ্যাও কম নয়। ইউরোপ-প্রবাসীর পত্র-এর গদ্যে কথ্য ক্রিয়াপদ, যার ওপর ঠাকুরের দুর্বলতা ছিল। পোস্টমাস্টার গল্পের সাধু গদ্য এমন কাব্যিক হলো কীভাবে? যোগাযোগ বা ঘরে বাইরে-এর গদ্যরীতির কথ্য ভাষার প্রাচুর্য, বিশেষণধর্মিতা, অলংকার ও অনুপ্রাসের ব্যবহারই শেষের কবিতাকে কাব্যিকতা দান করেছে। চোখের বালির কথ্য ভাষার চাল এত হৃদয়গ্রাহী কেমন করে হয়? গোরা এত নিরাভরণ কেন? কিংবা চোখের বালির গদ্যের সঙ্গে অমিলের এই পথে রবীন্দ্রনাথ কি স্বেচ্ছায় নাকি অবচেতনে এগিয়েছেন, তার অকাট্য প্রমাণ জুগিয়েছেন ফয়জুল ইসলাম। ‘লিপিকা’র গদ্যভাষা মণিমাণিক্যের মতো, এই গদ্য ছোটগল্প বা উপন্যাসে দেখা যায় না। এখানে কলকাতা ও এর আশপাশের ক্রিয়াপদের ব্যবহার আধুনিক ও যুতসই। তবে রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে বিচিত্র গদ্যরীতি মূলত নিজেকে অতিক্রমের নিরন্তর চেষ্টা। তার গদ্যরীতির নিজস্ব কৌশল সম্পর্কে মনোমোহন ঘোষ বলেছেন, ‘অতিদীর্ঘ সমাসের বর্জন, শব্দপ্রয়োগের লালিত্য এবং অনুচ্ছেদের অন্তর্গত বাক্য প্রবাহের স্বাভাবিক গতি ও শ্রুতিমাধুর্য (ছন্দোমূলক)।’ বর্তমানে যে গদ্যভাষায় সাহিত্য হচ্ছে, তা মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিরলস পরীক্ষা-নিরীক্ষারই দান।

মোট কথা, ‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’ বইয়ে ফয়জুল ইসলাম গদ্যের উৎপত্তি এবং নিরন্তর ক্রমবিকাশের ধাপগুলো বিস্তর তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যৌক্তিক যুক্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। আজকের এই বাংলা গদ্য কত কতজনের নিবিড়, নিরলস, ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল তার একটা দালিলিক কাঠামো হলো এই বই। কিছু বিষয়ের পুনরাবৃত্তি থাকলেও তা দৃষ্টিকটু নয়। বইটি ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ে এসে শেষ হলে আরও ভালো হতো। বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তি, নতুন লেখক কিংবা পাঠক-শিক্ষার্থীদের বইটি খুব কাজে দেবে।

ফয়জুল ইসলাম, আপনার নিরন্তর অধ্যবসায় ও মেধার এসব সবুজাভ ফসল বাঙালি আগলে রাখবে চিরকাল।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত