বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রাহুর দশা কাটছে না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও সংস্থাটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। গত ১৬ বছর ধরে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিমানে চাকরি করছিলেন তারা এখনো মোটামুটি রাজার হালেই আছেন। সংস্থাটিকে লাভজনক করার কথা বলে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশ সফরের নামে বিমানের অর্থ অপচয় করেছেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনা তার সঙ্গে বিশাল বহর নিয়ে যাওয়ায় বিমানের খরচের পরিমাণ বেড়েছে। এ পর্যন্ত ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে শেখ হাসিনার পেছনে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে আউট স্টেশনগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। প্রতি মাসেই বিশাল অঙ্কের টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।
আউট স্টেশনের কর্মকর্তারাও অনেকটা অলস সময় পার করছেন। অনেকেই সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। বিমানের ফ্লাইটে মাদকের চালানও আসে বলে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিমানের বহরে বোয়িং যুক্ত করা নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। লিজের কয়েকটি বোয়িংয়ের পেছনে প্রায় ২ হাজার ৩৭ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে সংস্থাটির। এ তথ্য বিশ্লেষণ করছে সরকারের উচ্চমহল। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে আশার বাণী হচ্ছে, বিমানের হ্যাঙ্গারের ভাড়া কমছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বিমানকে ‘অথর্ব প্রতিষ্ঠান’ আখ্যা দিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, ফ্লাইট অপারেশনের কোনো কাজে না আসলেও বিভিন্ন আউট স্টেশনে অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে আছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনবল। ঠিকই বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ও উচ্চ বেতন-ভাতা পেয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের পেছনে প্রতি বছর প্রায় আধা কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বিমানের। অপারেশন শাখার পাইলটদের মতে, তাদের পেছনে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করা হলেও কোনো কাজ করছেন না তারা। বিমানের টাকায় সপরিবারে বিদেশে বাস করছেন তারা। সংখ্যায় তারা ডজনখানেক হবেন বলে জানা গেছে।
বিমানের একজন পাইলট দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আউট স্টেশনে ২০১০ সালে জনবল নিয়োগ শুরু করেন বিমানের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত এমডি ক্যাপ্টেন নাসের। তার আমলে প্রথমে তিনটি স্টেশনে তিনজনকে অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে পাঠানো হয়। স্টেশনগুলো ছিল রিয়াদ, কুয়ালালামপুর ও দিল্লি। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও লন্ডনে পাঠানো হয় ম্যানেজার অপারেশন। কানাডা, ইতালিসহ আরও কয়েকটি দেশে আউট স্টেশন অফিস আছে। এসব স্টেশন বিমানের ‘অলস প্রজেক্ট’। এখন সংস্থাটির ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব স্টেশন। গত ১৬ বছরে বিমানে নানা অনিয়ম চলেছে। এখনো অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন যারা ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগবিরোধী হয়েছেন। আগেও তারা ভালো ছিলেন, এখনো তারা ভালো আছেন।
একই কথা বলেছেন বিমানের এক কর্মকর্তা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আউট স্টেশনগুলো আমাদের গলার কাঁটা। প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। কিন্তু খরচ অনুযায়ী আয় হচ্ছে না। গত সরকারের আমলে বিভিন্ন সেকশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন এসবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। বর্তমান কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে আউট স্টেশনের খরচ কমাতে। এ নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। আশা করি, দ্রুত একটা সিস্টেম দাঁড় করানো যাবে।’
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০টি বিমান সংস্থা বাংলাদেশে তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে এবং ৪৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল চুক্তি রয়েছে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করে শাহজালাল দিয়ে। কিন্তু বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার না থাকায় যাত্রীবেশে অপরাধীরা সহজেই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দুর্বলতার বিষয়ে সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোডাররা বিমান থেকে মালামাল নামানোর সময় পাচারের ঘটনা ঘটাচ্ছে। লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখায়ও অপরাধচক্র গড়ে উঠেছে। যাত্রী পরিবহনকে কেন্দ্র করে ট্যাক্সি কোম্পানির চালক ও দালালদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রান হচ্ছেন যাত্রীরা। দক্ষিণ ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে গার্মেন্ট সামগ্রীর সঙ্গে হেরোইনের চালান আসছে। মালামাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্য মাদকও আসে মাঝেমধ্যে। সোনার চালান আসছে নিয়মিত। একটি চক্র কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম করছে। অনিয়ম রোধ করতে হলে কার্গো এলাকার মালামাল সাজিয়ে রাখতে হবে। বিমানবন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বেবিচক, বিমান ও ম্যাজিস্ট্রেট একত্রে কাজ করবে। বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার হওয়া মালামাল দ্রুত নিলাম ডেকে বিক্রি করে দিতে হবে। কার্গো ভিলেজসহ পুরো বিমানবন্দরে যেসব সিসি ক্যামেরা আছে সেসব সচল কি না, তা পরিবীক্ষণ করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিমানযাত্রা শুরু করে। ২০০৭-০৮ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমানের ফ্লিটকে আধুনিকায়নের জন্য বোয়িংয়ের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। বিমানের বহরে যুক্ত হয় নতুন প্রজন্মের আধুনিক ১২টি বোয়িং উড়োজাহাজ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পুরস্কারস্বরূপ এয়ার মার্শাল (অব.) জামালউদ্দীনকে বিমানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার মিগ-২৯ মামলার সাক্ষী। তার মাধ্যমে বিমানের অর্থ লুটপাট ও লিজ বাণিজ্য শুরু হয়। সে সময় বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট হয়।
২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান। বছর পার হতে না হতেই বিমান দুটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ইজিপ্ট এয়ার থেকে ইঞ্জিন ভাড়ায় এনে সচল করা হয় একটি উড়োজাহাজ। অন্যটিকে বসিয়ে রেখে লিজের টাকা পরিশোধ করতে হয় বিমানকে। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় সচল উড়োজাহাজটিও। সব মিলিয়ে ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় সংস্থাটির।
সূত্র জানায়, গত ১৬ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সফরসঙ্গীদের পেছনে বিমানের প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনের প্রায় সবকটিতেই সরকারপ্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। প্রতিবারই নিউ ইয়র্কে নিয়ে যেতেন বিশাল বহর। এসব সফরে হাসিনার সঙ্গী ছিলেন অনেকেই। সফরে তিনি বিমানের বোয়িং ৭৭৭ ও ৭৮৭ সিরিজের অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ ব্যবহার করতেন। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংস্থাটি ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৮টি ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে।
এ প্রসঙ্গে বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অসহায় ছিলাম। শেখ হাসিনা যেখানেই যেতেন অন্তত একশজন সফরসঙ্গী নিয়ে যেতেন। বিমান কর্মকর্তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিতে এসবে উৎসাহ জোগাতেন।
তিনি এ কথাও বলেন, বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সব হ্যাঙ্গারের ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিমান মন্ত্রণালয় ও সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে এ দাবি জানিয়ে আসছিল অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এওএবি)। হ্যাঙ্গারের ইজারামূল্য পুনর্র্নির্ধারণে গঠিত কমিটির নতুন প্রস্তাবে প্রতি বর্গফুট ইজারার ভিত্তিমূল্য হবে ৪০ টাকা এবং ২০২৪-এর জুলাই থেকে ২০২৫-এর জুন পর্যন্ত ইজারামূল্য হবে প্রতি বর্গফুট ৪১ টাকা। প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক বৃদ্ধির পর ২০২৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত ইজারামূল্য ৪৬ টাকা ৩৯ পয়সা হবে।