শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সব দায় তো জনগণের

আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:০৬ এএম

একসময় শুনেছি, ‘দেশ’ গ্যাসের ওপর ভাসছে, ফলে গ্যাস রপ্তানি করতে হবে। আর এখন দেখছি, আমদানি না করলে দেশ চলছে না। উপরন্তু ক্রমাগত গ্যাসের দাম বাড়ছে।  কোম্পানিগুলো বলছে, গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ পাওনা অর্থ গ্রাহকের কাছে আটকে রয়েছে। পেট্রোবাংলার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এর পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ বকেয়ার সঙ্গে গ্যাসের সিস্টেম লস ও চুরি যুক্ত হয়ে লোকসান বা ভর্তুকির চাপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর মধ্যেই রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। এসব কিছু ছাপিয়ে উচ্চমূল্যে আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরতা গ্যাস খাতকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলেছে। পরিস্থিতি যত জটিল হোক না কেন শেষ পর্যন্ত দায় তো জনগণের। ফলে কোনো দায় নেই নীতিনির্ধারকদের। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকট হয়ে ওঠা গ্যাস খাতের সংকট অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই বরং সবই চলছে আগের ধারাতেই।

আর চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে এর খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। শোনা যাচ্ছে, উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত নানা পর্যায়ের লোকসান-অসংগতি আর অপচয় বহাল রেখে আবারও গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের প্রয়োজন এবং সম্ভাবনা দুটোই বাড়ছে। অথচ এই খাত নিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। যেহেতু জনগণ এটা ব্যবহার করবেই, শিল্পে, কৃষিতে এর প্রয়োজন আছে। পরিবহন বিদ্যুত্যের ওপর নির্ভরশীল। ফলে যে দামেই হোক মানুষ এই পণ্য ব্যবহার করতে বাধ্য। ফলে মানুষকে জিম্মি করেই বারবার বাড়ানো হচ্ছে দাম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা দেশের অর্থনীতিকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উৎপাদন ব্যয়, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। ফলে সবচেয়ে মনোযোগ দেওয়ার কথা ছিল যে খাতটির ওপর সেখানেই অদক্ষতা ও অনিয়ম দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকার, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে আশা করা হয়েছিল বড় ধরনের সংস্কার ও পরিবর্তনের হাওয়া বইবে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং দীর্ঘদিনের অনিয়মের হোতাদের সঙ্গে নিয়ে লুটপাটের পুরনো পথেই পরিচালিত হচ্ছে দেশের গ্যাস খাত।

আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, গ্যাস খাতে সিস্টেম লস, বকেয়া আদায় ও এ খাতের দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আগামীতে বকেয়া ও সিস্টেম লস কমে আসার পাশাপাশি গ্যাসের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘গ্যাস খাতের বকেয়া আদায়, সিস্টেম লস, চুরি এগুলো আমরা প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি। গ্যাসের সিস্টেম লস কমাতে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ  কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পয়েন্টে মিটার বসিয়েছে। এগুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। বকেয়া আদায়, সিস্টেম লস, চুরি এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কমিয়ে আনা কঠিন। এগুলো জোরালো তদারকির মাধ্যমে আমরা যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’ ‘গ্যাসের দাম কি বাড়ানো হবে’ এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকার নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে না। নতুন শিল্প ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমদানিকৃত গ্যাসের মূল্য দিতে হবে। কিন্তু যেসব শিল্পে সংযোগ বিদ্যমান রয়েছে, তাদের গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত থাকছে। এছাড়া সরকার গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে না। আগের সরকার নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিজের হাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বিইআরসির ক্ষমতা পুনরায় ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা তারা গণশুনানির মাধ্যমে যৌক্তিক মনে করলে করবে।’

এ কথায় একটু আশ্বস্ত হওয়া গেল যে, গণশুনানির ব্যবস্থা আবার চালু হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভুল নীতি ও দুর্নীতি বন্ধ না হলে শুনানিতে বিতর্ক করে কতটুকু লাভ হবে? কোম্পানি দাম বাড়াতে চাইবে ২০ শতাংশ, তীব্র বিতর্কের পর দাম বাড়ানো হবে ১২ শতাংশ। এর মধ্যে যে ফাঁদে ফেলে দাম বাড়ানোর কৌশল থাকে অতীতে তার প্রমাণ দেখা গেছে বারবার। বিল হিসেবে পাওনা বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়ে যাওয়ায় গ্যাস কোম্পানিগুলোর অর্থের সংকট বেড়েছে। আটকে থাকা এ পাওনার পরিমাণ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ৩৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে গ্যাস কোম্পানিগুলোর পাওনা বকেয়া বেড়েছে ১২ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওনা আটকে আছে বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল), যার পরিমাণ ১৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। যদিও তিতাস বলছে, তাদের গ্রাহকদের পাওনা বকেয়া এখন ১২ হাজার কোটি টাকার মতো। আর কোম্পানিটির সিস্টেমলস এখন ১১ শতাংশের কাছাকাছি। গ্যাস খাতে গ্যাস চুরি, অপচয় ও সিস্টেম লস তিতাসেরই সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে টিজিটিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘তিতাসের বকেয়া সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে। আমরা অব্যাহতভাবে এ বকেয়া আদায় মনিটরিং করছি। এছাড়া তিতাসের আওতাধীন গ্যাসের অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান চলমান রয়েছে। এগুলো তিতাসের চুরি যাওয়া গ্যাস উদ্ধারে সহায়তা করছে। এছাড়া গ্যাসের ছিদ্র ও পুরনো লাইনে ২ শতাংশ সিস্টেম লস হচ্ছে। এগুলো নতুন করে স্থাপনে প্রকল্প নিচ্ছে তিতাস। তবে অবৈধ গ্যাস সংযোগে তিতাস জোরালো অভিযান ও মিটারবিহীন গ্রাহক কমানো গেলে এ অদক্ষতা কমে আসবে।’ অতীত রেকর্ড বলে এই ধরনের আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না।

শুধু তিতাস নয় অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর বকেয়াও প্রচুর। বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেডের পাওনা আটকে আছে ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ২ হাজার ৮০৭ কোটি, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেডের ৬ হাজার ৩০০ কোটি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ১ হাজার ৭৪৬  কোটি, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ১ হাজার ৫৫ কোটি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ১ হাজার ১৪১ কোটি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস ফিল্ডের ১ হাজার ৭৬৪ কোটি, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ১ হাজার ৬৯৯ কোটি, বাপেক্সের ১ হাজার ৪৩৫ কোটি ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ৫৪ কোটি টাকা পাওনা গ্রাহকদের কাছে আটকে আছে। দেশের গ্যাস খাতে অদক্ষতার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখা হয় বিপুল পরিমাণ সিস্টেম লসকে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত। গড়ে তা ১০ শতাংশের মতো। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস তিতাসের। গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তিতাস গ্যাসের ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ সিস্টেম লস হয়েছে, যেখানে এর অনুমোদিত সীমা ২ শতাংশ। চলতি হিসাব বছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে কোম্পানিটি ৭১১ কোটি টাকা কর-পরবর্তী লোকসান গুনেছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছিল কোম্পানিটির। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিস্টেম লসের নামে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরি হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে। সিস্টেম লসে যে পরিমাণ গ্যাস নষ্ট ও চুরি হয়ে যাচ্ছে তার মূল্য অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার। সিস্টেম লসের পাশাপাশি তিতাসের বিপুল পরিমাণ গ্যাস অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে চুরি হয়ে যাচ্ছে। এ চুরি বিতরণ কোম্পানিগুলোর যোগসাজশে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না উৎপাদন বৃদ্ধি। ফলে বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে জ্বালানি বিভাগকে। এরপর তা জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিক্রি হচ্ছে ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম দামে। তাই গ্যাস খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। চলতি অর্থবছরে গ্যাস খাতে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগবে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা, যা আগের অর্থবছরগুলোয় ছিল গড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে এ খাতে ভর্তুকি লাগছে প্রায় তিনগুণ। গ্যাস খাতের বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন পরিচালন তহবিল নিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছে। তাদের গ্যাস বিক্রি বাবদ আয়ের বড় অংশই চলে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে, যা কোম্পানিগুলোর আর্থিক চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের  সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ কোম্পানিগুলো ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে। এর মধ্যে তিতাস ১৩৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা, বিজিএফসিএল ২০০ কোটি ৭০ লাখ, পেট্রোবাংলা ১ হাজার ২৯২ কোটি ৫৪ লাখ ও সিলেট গ্যাস ফিল্ড ১২৬ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে অন্যান্য কোম্পানিও।

বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমামের মতে, ‘গ্যাস কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস ও চুরি যাওয়া গ্যাসের অর্থমূল্য বিপুল। আসলে এগুলো গ্যাস খাতের অদক্ষতারই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে চলতে থাকলে গ্যাস খাতে কোনোদিকেই সুবিধা করতে পারবে না সরকার। দাম বাড়ানো কেন প্রয়োজন, এর পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর দক্ষতা কেমন, সেগুলোকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’ এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে আর দুর্নীতি দূর না করে গ্যাস কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর জোর প্রয়াস চালাচ্ছে। আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতির কারণে  দীর্ঘ দুই যুগ ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি বাপেক্সকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময় অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ বাপেক্সকে না দিয়ে বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে। বাপেক্সের মাধ্যমে গ্যাসকূপ খননে গড়ে যেখানে ৮০-১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়, সেখানে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে গড়ে ২০০-২২০ কোটি টাকা ব্যয় করানো হয়েছে। এতে কূপ খননের খরচ বেড়ে গ্যাসের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। ব্যয় বাড়ছে উৎপাদনে, বাড়ছে সিস্টেম লস, বাড়ছে আমদানি খরচ, বাড়ছে বকেয়া, বাড়ছে চুরি অতএব, কেন বাড়বে না দাম? জনগণের কাঁধে দায় চাপানোর এই যুক্তি মেনে নেওয়া, নাকি চুরি দুর্নীতি বন্ধ করা কোন পথে হাঁটবে দেশ?

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত