কুমিল্লায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্পের অধীনে ৬০ কোটি টাকার টয়লেট নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম দুনীতির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, টয়লেটের রিং নির্মাণে যে নির্দেশনা রয়েছে তা না মেনে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করছে ঠিকাদাররা।
জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আদর্শ সদর, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, লালমাই, দাউদকান্দি, নাঙ্গলকোট, তিতাস ও মোহনা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ২২৯টি করে টয়লেট নির্মাণের বরাদ্দ আসে। প্রতিটি টয়লেটের বরাদ্দ ৩৫ হাজার টাকা। সেই অনুযায়ী কুমিল্লায় ৮টি উপজেলায় প্রায় ১৭ হাজার টয়লেট বাবত ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরাদ্দ আসা এসব কাজ অন্তত ২০ জন ঠিকাদার এ ৮ উপজেলায় কাজ করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাঙ্গলকোট উপজেলা জোড্ডা পশ্চিম ইউপির চডিয়া বাজারের পশ্চিম পাশে একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে টয়লেট তৈরি সামগ্রী ইট, বালু, সিমেন্ট, টিন, কাঠ ও পিলার রাখা হয়েছে। যা খুবই নিম্নমানের। আর ওই সব নিম্নমানের সামগ্রি দিয়ে বরিশালের কিছু শ্রমিক টয়লেটের রিং, পিলার ও পানির পাত্র তৈরি করছেন। যা হাত দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলে ভেঙে যাবে এসব সামগ্রী। আবার প্রতিটি রিং ফাটল, তার ওপর সিমেন্টের গোলা দেওয়া হয় যাতে ফাটল দেখা না যায়। তাড়াহুড়ো করে ওই সব সামগ্রী উপকারভোগীদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
এ নিয়ে লেবার সরদার সেলিম বলেন, যেগুলো রিল ফাটল সেগুলো আমরা পরিবর্তন করে দিচ্ছি। আর মালিক আমাদেরকে যেভাবে কাজ করার জন্য বলছে। আমরা সে ভাবে কাজ করছি। আপনি মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, লালমাই, আদের্শ সদর, তিতাস, হোমনা ও দাউদকান্দি উপজেলায়ও নিম্নমানের কাছ হচ্ছে।
তবে ঠিকাদারদের অভিযোগ, প্রতিটি টয়লেটে সরকারি বরাদ্দ ৩৫ হাজার টাকা। তার মধ্যে ৫ হাজার টাকা ভ্যাট কেটে নিয়ে যায়। আর থাকে ৩০ হাজার টাকা। ওই টাকার মধ্যে ৩ হাজার টাকা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ও ২ হাজার টাকা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে দিতে হয়। আর থাকে ২৫ হাজার টাকা। আর ২৫ হাজার টাকার মধ্যে টয়লেট নির্মাণ করে নিজেদের লাভ খোঁজতে হয়।
এ বিষয়ে নোয়াপাড়া গ্রামের মালেক, কালাম, হাসেমসহ বেশ কয়েকজনে বলেন, টয়লেটগুলো যেভাবে তৈরি করে যাচ্ছে। নিছে বালু বা সিমেন্টের গোলা কিছুই দেয় না। আবার তাদের বাত খাওয়াতে, না হয় নাস্তার টাকা দিতে হয়।
এ বিষয়ে চডিয়া বাজার এলাকার এয়াকুব আলী বলেন, দেখলাম বাজারের পাশে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে টয়লেট বানানোর জন্য রিং তৈরি করেছেন বরিশালের লোকজন। তার টয়লেট তৈরি করার জন্য নিম্নমানের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসেন। তাড়াহুড়ো করে কয়েদিদের মধ্যে সে নির্মাণসামগ্রী দিয়ে রিং, পিলার, পানি রাখার পাত্র তৈরি করেন। সেইসঙ্গে নিম্নমানের টিন ও কাঠ দিয়ে টয়লেট তৈরি করছেন। টয়লেটের রিংগুলো গাড়িতে উঠানোর সময় ভেঙে যায়। প্রতিটি রিং পাঁঠা। এ পাঁঠা রিংয়ের ওপর সিমেন্টের গোলা দিয়ে দেয়। যাতে পাঁঠা দেখা না যায়।
এ বিষয়ে জোড্ডা পশ্চিম ইউপি সদস্য কালাম বলেন, সরকারি বরাদ্দ যতটুকু তার কিছুই দিচ্ছে না তারা। কোনমতে দায়সারাভাবে কাজ করে গরীব মানুষগুলো বুঝিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি টয়লেট ভেঙে দেখলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জোড্ডা পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, এ টয়লেট তৈরি করার আগে আমাদেরকে ট্রেনিং দিয়েছেন। টেনিংয় অনুযায়ী টয়লেট হয়নি। খুবই নিম্নমানের কাজ হয়েছে। আমাদের কাছে এনিয়ে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছে। এগুলো নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। খুবই দুঃখ জনক।
এ বিষয়ে রেহান এন্টারপ্রাইজ মালিক কাজিম উদ্দিন বলেন, জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর অফিসের প্রকৌশলীকে ৩ হাজার ও উপজেলা অফিসে ২ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার ৫ হাজার টাকা ভ্যাট কেটে নেয়। আমরা কয়টার কাজ করব। আমার হেসাখাল ইউপিতে ভালো কাজ হচ্ছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুন্সি এন্টারপ্রাইজের মালিক সজিব বলেন, ভালো কাজ হচ্ছে। যা পারেন লিখেন কোনো সমস্যা নেই। টাকা দিলে সবঠিক।
এ বিষয়ে নাঙ্গলকোট উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকৌশলী কামাল হোসেন বলেন, নাঙ্গলকোটে ১০টি ইউনিয়নে কাজ করছেন মুন্সি এন্টারপ্রাইজ। আর বাকিগুলোতে অন্যনরা। সেখানে নিম্নমানের কাজ হবে। সেখানে আমরা কাজ বন্ধ করে দেব। ২ হাজার টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
কুমিল্লা জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ বলেন, কুমিল্লায় ৮ উপজেলায় প্রায় ১৭ হাজার টয়লেট তৈরি করা হচ্ছে। এতে ২০ জনের মত ঠিকাদার কাজ করছেন। প্রতি টয়লেট বাবদ কারও কাছে থেকে টাকা টাকা নেওয়া হয় না। যে বলছে তা মিথ্যা বলছে। কোথাও অনিয়ম হলে কাজ বন্ধ করা হবে। এসব নিউজ করে কি লাভ হবে। আমার বিরুদ্ধে আরও অনেক নিউজ হয়েছে, কিছুই হয়নি। কুমিল্লাতে আরও বড় বড় অনিয়ম-দুনীতি হচ্ছে। এগুলো লিখে শেষ করতে পারবেন না। আর এসব কিছু দেখেন প্রকল্প পরিচালক তবিবুর রহমান।
প্রকল্প পরিচালক তবিবুর রহমান বলেন, শুধু কুমিল্লা নয় সারাদেশে কাজ চলছে, আমাকে দেখতে হয়। এটি জেলা প্রকৌশলী দেখবেন। আর কোথাও অনিয়ম হলে কাজ বন্ধ করা হবে।