সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনাই টেকসই উন্নয়ন

আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:২৬ এএম

আমাদের দেশে খাদ্যনিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হলেও, নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে উৎপাদক, বিপণনকারী থেকে ভোক্তা সব পর্যায়ের অংশীজনকে সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। আমরা বাঁচার জন্য খাই। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খাই। কিন্তু প্রতিদিন খাদ্যের নামে যা খাচ্ছি, তা কতটুকু নিরাপদ? চারদিকে ভেজালের সমারোহ। নিরাপদ খাদ্যের অভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য হুমকির মুখে। সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। কিন্তু আমাদের দেশে বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তি কঠিন করে তুলছে কিছু বিবেকহীন অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খাদ্যকে অনিরাপদ এবং বিষে পরিণত করা হচ্ছে। ১৭ কোটি মানুষ রয়েছে ভেজাল আতঙ্কে। অথচ সুস্থভাবে বেঁচে থাকা আমাদের মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। জাতিসংঘ বহু আগেই খাদ্য অধিকারকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা বাংলাদেশের মৌলিক দায়িত্ব। এখন শুধু খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করলেই হবে না, সেটিকে নিরাপদও রাখতে হবে। কেননা প্রতি বছর বিশ্বের ২০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্যজনিত রোগে প্রাণ হারায়। বাংলাদেশেও অনিরাপদ খাবারের কারণে বছরে মারা যায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। আবার অনিরাপদ খাবার গ্রহণের কারণে প্রতিদিন ৫ শতাংশ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। অনিরাপদ খাবার গ্রহণের ফলে শিশু, গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে তৈরি হয় পুষ্টিহীনতা। গড়ে ওঠে পুষ্টিহীন একটি প্রজন্ম। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যে ভেজালের কারণেই দেশের মানুষের বিভিন্ন রকমের ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানিসহ আরও জটিল রোগ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একে নিয়ন্ত্রণে আনতে ভেজালমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশের বাড়তি খাদ্য উৎপাদনে বড় অর্জন আনতে গিয়ে বেড়েছে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ। আর মাটির ওপর নির্বিচারে রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু খাদ্যের গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে। প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যের উৎসস্থান থেকে পরিবহন ও গুদামজাতেও রাসায়নিক মেশানো হয়। শস্য ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মাছ ও আমিষের উৎস ডিম-মুরগিও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মাছের খামারেও ব্যবহার হচ্ছে নানা বর্জ্য। পোলট্রি মুরগির বর্জ্য জমিতে ও মাছের খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে খাদ্যের উৎস নিরাপদ থাকছে না। অসাধু ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীদের কারসাজির কারণে খাদ্য দূষিত হচ্ছে।

বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি জুস, চকলেট, চানাচুর ইত্যাদি উৎপাদনে কোম্পানিগুলো নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে দেদার ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশিয়ে বাজারজাত করে যাচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী পানির বোতলে দূষিত পানি, মুড়িতে ইউরিয়া, বিষাক্ত এনার্জি ড্রিংক ও জুস, শিশুখাদ্যেও ভয়াবহ ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। মেশানো হয় মসলায় ইটের গুঁড়া ও হলুদে লেড ক্রোমেট। মুরগির শরীরে ব্যবহৃত নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও ওষুধে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক জীবাণু। গরুর মাংসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ পদ্ধতি দেখা যায়। দ্রুত বৃদ্ধির জন্য গরুর শরীরে দেওয়া হয় বিভিন্ন গ্রোথ হরমোন। গরুর শরীরে পিটুইটারি ইনজেকশন দিয়ে দুধের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে। যেটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য বড় রকমের ঝুঁকি। নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তায় ২০১৩ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্র্তৃপক্ষ। ভেজালবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তারা কাজ করছে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেজালবিরোধী অভিযান। তার পরও কমছে না ভেজালের ব্যাপকতা। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সরকার আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করলেও খাদ্য নিরাপদ করতে আমাদের অর্জন সামান্যই। শুধু আইন বা প্রতিষ্ঠান থাকলে হবে না, আইনের প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করা দরকার। আমরা আশা করব, ভেজালবিরোধী অভিযান কঠোর হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত হবে। ভেজাল পণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে অভিযান নিয়মিত থাকলে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

বহির্বিশ্বে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ খাবারের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। কিছুদিন পর পরই কর্র্তৃপক্ষ ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ আর্থিক জরিমানা করছে। জরিমানা দিয়ে আবার একই ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে তারা। কাজেই অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি বন্ধে শুধু জরিমানামূলক শাস্তি নয়; সরকারকে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সময় এসেছে। পাশাপাশি ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতেও প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো দরকার। নিরাপদ খাদ্যের কার্যক্রমটি বর্তমানে একাধিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় সমন্বয়ের অভাব প্রকট। পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিএসটিআইয়ের গবেষণা ও তদারকি আরও বাড়াতে হবে। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় শক্তিশালী খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রক ও তদারকি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশে খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের বিপরীতে নজরদারির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এখনো অপ্রতুল। এ বাস্তবতায় উল্লিখিত দেশের সংস্থাগুলোর নীতি ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এখানে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরও বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং সুস্থ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে। সুস্থ জীবনের জন্য নিরাপদ খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। এর নিশ্চয়তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত