মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আজকের বৈঠকটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ঘটনা। ভারত তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও বিষয়টি অন্য কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই মনে করছেন, আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়টিও আসতে পারে। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, এমন অবস্থায় দুই দেশের সর্বোচ্চ নেতার বৈঠকের আলোচ্যসূচি এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণভাবেই কৌতূহল রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে চলছে এ বিষয়ে তুমুল আলোচনা এবং কৌতূহল। অনেকেই ধারণা করছেন, বৈঠকটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের বাণিজ্যিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই শেষ হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের বাণিজ্যিক বিষয়ের পাশাপাশি ভারত- বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা চলাকালে হয়তো সুযোগ বুঝে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তার দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্কের বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের কড়া নিরাপত্তায় দিল্লিতে অবস্থান করছেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, আলোচনায় তা উঠে আসতে পারে। মনে রাখা ভালো, বর্তমানে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশিদের সাধারণ ভ্রমণ ভিসা বন্ধ রয়েছে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে তারা মেডিকেল ভিসা দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে, অন্য দেশ কতটুকু তাতে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৈঠকের মূল লক্ষ্য, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা। তবে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সাক্ষাতের সুনির্দিষ্ট সময় যদিও এখনো জানানো হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে বৈঠকে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি সহযোগিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচিত হবে। কারণ ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক আরও সুসংহত করার লক্ষ্যে উভয় দেশই এই বৈঠকের জন্য নিবিড়ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে।
চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার ভারত। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী নয়াদিল্লি। পাশাপাশি নিজ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষ কর্মী ভিসা পাওয়া সহজ করতে চায় ভারত। তাছাড়া ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে বলেও দাবি করেন মোদি। এত কিছুর পরও ভারতের উচ্চ শুল্কনীতি ও অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তনে ভারতের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে দিল্লির কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কিন্তু সূত্রগুলো বলছে, নয়াদিল্লি ওয়াশিংটনকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে ইচ্ছুক। যদিও এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক শুল্ক আরোপের কোনো পরিকল্পনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু প্রকাশ করেনি। চীনকে মোকাবিলায় ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারত্ব রয়েছে। সেই সম্পর্ক আরও জোরদারে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশটির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানো ও দক্ষ নাগরিকদের ভিসা পদ্ধতি সহজ করা নিয়ে আলোচনা হবে। দুই নেতার রাজনৈতিক দর্শনে অনেক মিল। জনসমক্ষে চটকদার বক্তব্য, আবেগমথিত প্রচারণা এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রকাশে উভয়েই সফল। নিজেদের একান্ত ভক্তগোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখার ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ সফল। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ সেøাগানের মতোই মোদির ‘নতুন ভারত’ নির্মাণের স্বপ্ন একধরনের রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশল জনমানসে সহজেই প্রভাব বিস্তার করে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বর্তমানে এক বিশেষ পরিসরে রয়েছে। বহু বৈশ্বিক ইস্যু, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য সম্পর্ক এবং পরমাণু শক্তির প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলমান। আজকের বৈঠকটি দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাইরে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার মূল ক্ষেত্রগুলো নিম্নরূপ হতে পারে:
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা : উভয় নেতাই বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে আলোচনা করতে পারেন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করার উপায়গুলো খুঁজে বের করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। উভয়ের আলোচনায় শুল্ক কমানো, বাজারে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের ওপর ফোকাস করা হতে পারে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা : ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা’ ভারত-মার্কিন সম্পর্কের একটি মূল স্তম্ভ। এই বৈঠকে উন্নত সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তিগুলোতে অগ্রগতি দেখা যেতে পারে। এছাড়াও, সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টা এবং গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ও আলোচ্যসূচিতে থাকতে পারে বলে অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক মনে করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তি : জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উভয় দেশই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর ফলে আলোচনায় নবায়নযোগ্য শক্তি উদ্যোগ, উন্নত-আধুনিক প্রযুক্তি বিনিময় এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়গুলো উঠে আসতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ভারতের কাছে রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা : মোদি-ট্রাম্প বৈঠকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগগুলো উঠে আসতে পারে। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এই আলোচনায় গুরুত্ব পেতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে বাংলাদেশের ভূমিকা আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদিও এমন সম্ভাবনা তেমন প্রকট নয়।
সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ মোকাবিলা : দক্ষিণ এশিয়ায় ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘উগ্রবাদ’ প্রতিরোধে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশ তার কৌশলগত অবস্থান এবং উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যার কারণে, এই প্রচেষ্টাগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উভয় নেতা বাংলাদেশকে উগ্রবাদ মোকাবিলা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
রোহিঙ্গা সংকট : মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট একটি জরুরি মানবিক সমস্যা। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তা প্রদান এবং বাংলাদেশকে এই সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। এছাড়াও, সংকটের মূল কারণগুলো সমাধান এবং শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কৌশলগত আগ্রহের বিষয়। ট্রাম্প-মোদি বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো সমর্থন করার জন্য ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতার সুযোগগুলো তুলে ধরা হতে পারে।
অবকাঠামো ও সংযোগ : ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিবহন নেটওয়ার্ক, শক্তি গ্রিড এবং ডিজিটাল সংযোগসহ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে সহযোগিতা করতে পারে। উন্নত অবকাঠামো শুধুমাত্র বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না, বরং আঞ্চলিক সংযোগ ও বাণিজ্যকেও শক্তিশালী করবে।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ : বৈঠকে তিন দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, বাংলাদেশ) মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রে মার্কিন ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে।
টেকসই উন্নয়ন : ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিবেশগত ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনে সহায়তা করতে পারে। সমন্বিত উদ্যোগগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।
কূটনৈতিক ও কৌশলগত বিবেচনা : ট্রাম্প-মোদি বৈঠকে আঞ্চলিক, বৈশ্বিক কূটনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব থাকবে। দুই নেতা বহুপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
কোয়াড জোট : ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া সমন্বিত কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ (কোয়াড) মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক প্রচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এটিকে এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় করে তোলে। বৈঠকে আলোচনা হতে পারে, বাংলাদেশকে কোয়াড উদ্যোগগুলোতে জড়িত করার এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রচারের উপায়গুলো নিয়ে।
চীনের প্রভাব : বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (ইজও)-এর অধীনে বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্য উদ্বেগের বিষয়। নেতারা চীনের প্রভাবকে প্রতিহত করার এবং এই অঞ্চলে বিকল্প উন্নয়ন মডেল প্রচারের কৌশলগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
এটা ঠিক, ট্রাম্প-মোদি বৈঠক মার্কিন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে চলেছে, যার প্রভাব আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে পড়বে। যদিও এর মূল লক্ষ্য হবে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালীকরণ। তবে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেলেও তা নিয়ে তেমন চিন্তার কিছু নেই। এই বৈঠক নিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে অহেতুক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ভাবটা এমন, এরপরই হয়তো বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হবে! আসলে যারা এমনটি ভাবেন, এক কথায় বলতে হয় এমন চিন্তার পক্ষ অকাট মূর্খ। তারা জানেন না, কীভাবে একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। নিশ্চিত যে, এই বৈঠক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখবে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের চিন্তার কিছু নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে, আমেরিকার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশকে। সুতরাং আলোচনায় সিদ্ধান্ত যাই-ই হোক, বাংলাদেশকে সে বিষয়ে দুর্ভাবনায় পড়তে হবে না।
লেখক: চিকিৎসক ও কলাম লেখক