বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

এক মালার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ

আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৫ এএম

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টসের (বিআরআইসিএম) চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার মালা খান প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই গ্রেড-৩ পদের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের প্রভাব খাটিয়ে তিনি এ নিয়োগ পান বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন, প্রশাসনিক, আর্থিক ও গবেষণা কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং পুরস্কার জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ায় তখন তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ সাহস পাননি। তবে এসব অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা হওয়ার পর সেগুলোর সত্যতা জানতে গতকাল সোমবার দুপুরে বিসিএসআইআরে অভিযান চালিয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক সোয়েব আহমেদের নেতৃত্বে একটি দল এ অভিযান চালায়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মালা খানের অফিসে গোপন কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই কক্ষে বিভিন্ন ধনের দেশি-বিদেশি মদসহ যৌন কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম পাওয়া যায়। এ ঘটনায় দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়।

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, বিআরআইসিএমের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার মালা খানের বিরুদ্ধে যোগ্যতা না থাকলেও গ্রেড-৩ পদের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেওয়া, অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন, টেন্ডার জালিয়াতি, প্রশাসনিক ও গবেষণা কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি, পুরস্কার জালিয়াতি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব অভিযোগের সত্যতা জানতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গতকাল অভিযান চালায়।

দুদকের উপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আখতারুল ইসলাম জানান, বিসিএসআইআরে বিভিন্ন আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, গবেষণায় অনিয়ম, পুরস্কার জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানে যায়। অভিযানকালে কেমিক্যাল মেট্রোলোজি অবকাঠামো সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দিয়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন এবং স্পেসিফিকেশন ও বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী কেনাকাটা না করে অর্থ উত্তোলনসহ অন্যান্য অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক টিম। এ ছাড়া সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই সেসব যন্ত্রপাতি কিনে স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে কেনা দামের চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে দরপত্রের কাজ সম্পন্ন করে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে দুদক টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়।

অভিযানের সময় সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওই প্রকল্পের আওতায় কেমিক্যাল কেনা হয়েছে ১ কোটি ৮০ হাজার টাকার। কিন্তু পরে ৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার দরপত্র দেখানো হয়েছে। বাদবাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। অভিযানের সময় দুদক টিম ১১টি যন্ত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পায়, যেগুলো কোনোরকম দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই কেনা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, এগুলো আগামী অর্থবছরে দরপত্রের মাধ্যমে কেনা বলে দেখানো হবে, যা সম্পূর্ণরূপে বিধিবহির্ভূত। অভিযানের সময় পাওয়া অনিয়মের তথ্যগুলোর বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশন বরাবর বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এর আগে গতকাল বিকেলে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বিসিএসআইআর এবং বাংলা একাডেমিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের এনফোর্সসেন্ট ইউনিটের দুটি টিম এ অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে এনফোর্সমেন্ট টিম। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কমিশন পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’

বিসিএসআইআর সংক্রান্ত দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়, ২০১৫ সালে মালা খানকে বিআরআইসিএমের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার (গ্রেড-৩) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে নিয়েগের জন্য ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরও মাত্র আট বছর সাত মাসের প্রথম শ্রেণির চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়োগ লাভ করেন তিনি। এর মধ্যে তার সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে ছয় বছর এবং সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে দুই বছর সাত মাসের অভিজ্ঞতা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের প্রভাব কাজে লাগিয়ে চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার পদে চাকরি পান মালা খান। পরে এ নিয়ে মামলা (নম্বর-৬৭/২০১৮) হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ায় তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ সাহস পায়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মালা খানের অফিসে অভিযান চালিয়ে গোপন কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই কক্ষ থেকে বিভিন্ন ধনের দেশি-বিদেশি মদ ও যৌন কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে অফিসে যাওয়া বন্ধ রাখেন মালা খান। গতকাল পর্যন্ত তিনি অফিসে যাননি বলে তার সহকর্মীরা জানান।

আরও যত অভিযোগ : মালা খান বিআরআইসিএমের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নিয়মনীতি না মেনে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের আয়ের সিংহভাগই সরকারকে অবহিত না করা এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের নামে লোপাটের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যের নামে-বেনামে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও গবেষণাসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ অর্থ খরচের ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মালা খান আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি না মেনে নিজের আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি আউটসোর্সিংয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন লোকদেরও নিয়োগ দেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে সরকারি অর্থ ব্যয় করে নিজের নামে পুরস্কার এনেছেন। এর মধ্যে ‘ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ অন্যতম। এ পুরস্কার নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তোলেন।

মালা খানের বিরুদ্ধে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রেও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ-এর বাংলাদেশ শাখা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন, কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুমোদন নেই উল্লেখ করে ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়। ইউজিসির উপপরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ) ড. দুর্গা রানী সরকার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ-এর বাংলাদেশে থাকা স্টাডি সেন্টার শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান নয়। তাই ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমসহ পিএইচডি প্রদানের বিষয়টি ইউজিসির অনুমোদিত নয়। এরপর ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া পিএইচডির গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিসিএসআইআর সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) ফাতেমা জাহান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি কর্র্তৃক মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান সরকার কর্র্তৃক অনুমোদিত নয় এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের কোনো এখতিয়ার নেই। বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন পর্যন্ত পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলা বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি কর্র্তৃক মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের কোনো এখতিয়ার নেই।’

অন্যদিকে, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বিসিএসআইআর সচিবের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক ছিলেন মালা খানের পিএইচডি থিসিসের সুপারভাইজার। তিনি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন না। মালা খানের পিএইচডি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন তুললে তিনি ২০১৭ সালে দুটি এবং ২০১৮ সালে আরেকটি মামলা করেন।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মালা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে, তারা কাগজপত্র তৈরি করে অভিযোগ দাখিল করছে। কী কী কাগজপত্র দিচ্ছে তা আমি জানতেও পারছি না। এসব বিষয় দুদকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি। থানায় জিডিও করেছি। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেগুলো তদন্তে প্রমাণিত হয়নি এবং আমি সংবাদ সম্মেলন করে তা জানিয়েছি।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত