শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকার লোভে হাসিনা ভারতের সঙ্গে নতজানু নীতি নিয়েছিল। এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল নদীর পানির হিস্যা আদায়ে। পাশর্^বর্তী দেশটির সঙ্গে আমাদের অভিন্ন নদীগুলোর পানি ভারত একতরফাভাবে ব্যবহার করেছে। শুকনা মৌসুমে পানি ধরে রেখে বাংলাদেশে খরা তৈরি করেছে আর ভরা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়েছে বন্যায়। আওয়ামী সরকারের আমলে ভারতের বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতেও উচ্চকিত হয়নি। অনেক অভিন্ন নদীতে চুক্তি করতে পারেনি আর যেসব নদীর বিষয়ে চুক্তি ছিল সেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ তিস্তা। ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার ৩৭.৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশকে বরাদ্দ করা হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা, তার রাজ্যে পানি সংকটের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে চুক্তিটি স্থগিত করে দেওয়া হয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ দেশের মানুষ অন্য অনেক বিষয়ের মতো তিস্তার ন্যায্য হিস্যা নিয়েও আশাবাদী হয়ে উঠেছে। সোমবার তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া এবং এ নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে চোখেমুখে ক্ষোভ আর আশা নিয়ে লাখো মানুষ এসেছিল তিস্তাপাড়ে। তাদের প্রত্যাশা, প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা নয়, বরং বর্তমান সরকারের আমলেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন দাবির কথাই ধ্বনিত হয়েছে লাখো মানুষের কণ্ঠে। উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার ১১টি পয়েন্টে চলছে ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচি। ৪৮ ঘণ্টার এ কর্মসূচি পালন করছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি।
সমাবেশে এসে অনুভূতি প্রকাশ করেছে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। তিস্তাপাড়ের কৃষক জমসেদ মিয়ার (৬৮) মুখের ভাষায়, ‘তিস্তা হামার সব শেষ করছে বাহে। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ছিল। একে একে আটবার তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়েছে সব। এখন মানুষের (অন্যের) জমিতে থাকি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদ করতে পারব বাহে।’ আরেক কৃষক তিস্তাচর এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী (৬৫)। তিনি বলেন, ‘খরাতেও ভাঙে, বন্যাতেও ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে বাপ-দাদার ভিটে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। যতটুকু আছে তাও ভাঙনের মুখে। শুনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু শুধু শুনিই, বাস্তবায়ন হয় না। আমরা চাই অন্তত এবার সেটা হোক।’
সমাবেশের অন্যতম বক্তা ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ভারতের উদ্দেশে বলেন, যদি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চান তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করেন। আর আমাদের সঙ্গে বড় দাদার মতো আচরণ বন্ধ করেন। আমরা আমাদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে চাই। আমরা আমাদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই। আমরা অবশ্যই ভারতকে বন্ধুত্বের সঙ্গে দেখতে চাই। যে বন্ধুত্ব হবে সম্মানের সঙ্গে আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার।
এসব কথা অনুরণিত হয়েছিল বাকিদের কণ্ঠেও। সবারই আশা, গণআন্দোলনের ফলে যে সরকার প্রতিষ্ঠত হয়েছে তা এ দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা অনুসারে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। ভারতের প্রতি নতজানু নয় বরং সম্মানজনক বন্ধুত্বের অধিকার আদায় করবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনেরও আগ্রহ ছিল, প্রয়োজনে সেই আগ্রহকে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু বিগত সরকার ভারতের স্বার্থে চীনের আগ্রহকে পাশ কাটিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে তিস্তার লড়াই আমাদের জন্য এক মহাগুরুত্বপূর্ণ জীবনমরণের ব্যাপার।