উচ্চমূল্যের এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির আগে সব গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে অবৈধ সংযোগমুক্ত করতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ একাধিক নির্দেশনা দিলেও গত সাত বছরে তা কার্যকর হয়নি। অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাধ্যমের বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরির পাশাপাশি রয়েছে গ্যাস বিতরণে অতিমাত্রায় সিস্টেম লস।
এমন পরিস্থিতিতে এলএনজি আমদানির বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বুধবার গণশুনানির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত জানুয়ারিতে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ ও বিদ্যমান শিল্পকারখানা সম্প্রসারণের জন্য ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন অযাচিত ব্যয়, লোকসান আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জ্বালানি খাতের সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে গেছে। এ ব্যয় সামাল দিতে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ আর ক্যাপটিভে ১৬ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৩০ টাকা। পরে আরেক দফা নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের দাম ১৪ থেকে বাড়িয়ে ১৪.৭৫ এবং ক্যাপটিভে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩০.৭৫ টাকা করে সরকার।
শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হলেও সংকট দূর হয়নি। উল্টো ভয়াবহ গ্যাস সংকটে কারখানার উৎপাদন কমেছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিতরণ কোম্পানিগুলোর ব্যর্থতার দায় ভোক্তার ওপর চাপাতেই এভাবে দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ব্যয় বাড়বে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা বলছেন, চুরি ও অপচয় বন্ধ করে হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। শিল্পের পাশাপাশি আবাসিকেও বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরি হচ্ছে। সিস্টেম লস হিসেবে যে হিসাব দেখানো হয়, তার অন্তত ৬-৭ শতাংশ চুরি যাওয়া গ্যাস। চুরি ও অপচয় বন্ধ হলে গ্যাস সংকট কমত। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিরও প্রয়োজন পড়ত না এখন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর পেছনে সরকারের যুক্তি-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের বাড়তি আমদানি দাম মেটানো।
সরকারি সূত্র এবং বেসরকারি পর্যায়ের গবেষকদের মতে, অপচয়ের মূল জায়গাগুলো হলো পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানার পুরনো যন্ত্রপাতি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সেকেলে প্রযুক্তির বয়লার। আর অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস চুরির নেপথ্যে রয়েছেন বিতরণ কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
যদিও জ্বালানি বিভাগ বলছে, গ্যাস খাতে সিস্টেম লস কমিয়ে এ খাতের দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আগামীতে সিস্টেম লস কমে আসার পাশাপাশি গ্যাসের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লসের বিষয়টি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির শুনানিতে গুরুত্ব পাবে বলে জানিয়েছেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি দক্ষতা (এনার্জি ইফিশিয়েনসি) বিষয়ের গবেষক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে যেভাবে আটঘাট বেঁধে নামা দরকার, সে ধরনের উদ্যোগ কখনই চোখে পড়েনি। এটি করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল, বাড়তি অর্থ বরাদ্দ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দরকার।
বৈশ্বিক মান অনুযায়ী, গ্যাসের গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লসের মাত্রা দশমিক ২০ থেকে দশমিক ৩০ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস ৫ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত। গড়ে তা ১০ শতাংশের মতো। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস তিতাসের। গত বছর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তিতাস গ্যাসের ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ সিস্টেম লস হয়েছে, যেখানে এর অনুমোদিত সীমা ২ শতাংশ।
এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, তিতাসের আওতাধীন গ্যাসের অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ কার্যক্রম আগের চেয়ে জোরদার হয়েছে। কোথাও কোথাও উচ্ছেদের পর আবার নতুন করে অবৈধ সংযোগ নিচ্ছে। এটি কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) নেতারা বলছেন, ইলেকট্রনিক ভলিউম ক্যারেক্টার (ইভিসি) মিটার বসালে শিল্পে গ্যাস বিল কমে আসবে। তাই বিতরণ কোম্পানি ইভিসি মিটার দিচ্ছে না। ইভিসি দিলে তাদের কারিগরি অপচয় চাপা দেওয়ার আর সুযোগ থাকবে না।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ১২ থেকে ৩০ টাকা করেছিল। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এরপরও গ্যাস পাচ্ছি না। বরং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
পেট্রোবাংলা দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন দামে যে গ্যাস কেনে তাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের গড় দর ৬ টাকা ৭ পয়সা। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির দাম পড়ে ৬৫ থেকে ৭১ টাকা পর্যন্ত। দেশীয় ও আমদানি করা এলএনজি মিলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্য ছিল ২৪.৩৮ টাকা, যা পাইকারি দরে বিক্রি করা হয় ২২.৮৭ টাকায়। এতে ইউনিটপ্রতি ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো বিশেষ করে তিতাস সিস্টেম লসের নামে যে গ্যাস ডাকাতি করছে, সেটা বন্ধ করা গেলে ১২৫ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় বন্ধ করা সম্ভব। এর সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে পুরনো গ্যাসকূপ সংস্কারের মাধ্যমেও গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এগুলো করতে পারলে তো ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।