মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

ঈদের আগে চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪৯ এএম

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে শুরু থেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ^ জুড়েই পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব নতুন করে বেড়েছে।

চীন শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের ভারতের চিকিৎসা ভিসার জটিলতায় চীন এগিয়ে এসেছে। আর ভারতের সঙ্গে সীমান্তে অস্থিরতাসহ নানা জটিলতা চলমান। এই পরিস্থিতিতে চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৮ মার্চ সবকিছু ঠিক থাকলে বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা। বেইজিং ও চীনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, তার প্রস্তুতি নিতে গত রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিবের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, বৈদেশিক ঋণ, কানেকটিভিটি, পানি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, পানি, বৈদেশিক ঋণ, কৃষি, কানেকটিভিটি, জ¦ালানিসহ বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে কোন বিষয়গুলো বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হবে, সে বিষয়ে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে চীন সম্পর্কিত সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের তালিকাও রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ কী বলবে, সেটি ঠিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি ক্রমপরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও দুই নেতার মধ্যে আলোচনার বিষয় এসেছে।

চীনের প্রেসিডেন্টর তিন বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, আগামী ২৬ মার্চ চীনের হাইনান প্রদেশে বোয়াও ফোরাম কনফারেন্সে যোগ দিতে দেশটির উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। পরদিন ২৭ মার্চ সম্মেলনের উদ্বোধনী প্লেনারি সেশনে বক্তব্য দেবেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চীনের স্টেট কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রিমিয়ার দিং ঝুঝিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে।

সফরের তৃতীয় দিন ২৮ মার্চ বেইজিংয়ের গ্রেট হলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূস হুয়াই কোম্পানির উচ্চ-প্রযুক্তিসম্পন্ন এন্টারপ্রাইজ পরিদর্শন করবেন। এ ছাড়া এদিন চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে। সফরের শেষদিন ২৯ মার্চ চীনের বিখ্যাত বিশ^বিদ্যালয় পিকিং ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেবে এবং সেখানে তিনি বক্তব্য রাখবেন। এরপর বেইজিং থেকে চীনের একটি বিমানে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চীনের হাইনান প্রদেশে ২৫ থেকে ২৮ মার্চ অনুষ্ঠেয় বাউ (বিওএও) ফোরাম ফর এশীয় কনফারেন্সে যোগ দিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এরপরই বাউ ফোরাম কনফারেন্সে প্রধান উপদেষ্টা যোগ দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের চীন সফরেও ড. ইউনূসের চীন সফরের বিষয়টি আলোচনায় আসে। দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উচ্চপর্যায়ের সফরের বিষয়ে আলোচনা করেন। জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বিনিয়োগ সম্পর্কসহ বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পাবে।

২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুরু করেন। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময়ে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। শি জিনপিং সম্প্রতি আরও তিনটি উদ্যোগ নিয়েছেন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ।। ২০২২ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরের সময়ে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেন।

ভূরাজনৈতিক বিষয় : প্রায় দেড় দশক ধরেই বিভিন্ন ইস্যুতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অগ্রসরমাণ ছিল। কিন্তু তারপরও বলা হয়ে থাকে, ১৬ বছর এই অঞ্চলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কই বেশি উষ্ণতা ছিল, যা গত বছরের ৫ আগস্টের পর খারাপ হতে থাকে। কিন্তু পটপরিবর্তনের পরও চীন বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল চমৎকার। এখন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে ইউনূস সরকার। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তি এবং তারা এ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার ভারতও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ চায়। আর এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারসাম্য রক্ষা করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বৃহৎ শক্তিগুলোর ভারসাম্য ঠিক রেখে জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার করা।

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সহযোগিতা : গত বছরের ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা অনেকটাই সহজ ছিল। বছরে ১৫ লাখের বেশি ভারতীয় ভিসা ইস্যু করা হতো। বিশেষ করে মেডিকেল ভিসা ছিল অনেকটাই সহজ। কিন্তু এখন মেডিকেল ভিসা চালু থাকলেও খুব কম পরিমাণে ভিসা হচ্ছে। ভিসা জটিলতার কারণে রোগীরা বেকায়দায় পড়েছে। সব বিবেচনায় চীন হাত বাড়িয়েছে। কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের জন্য নির্ধারিত করার বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে চীনকে অনুরোধ করতে চীন তা গ্রহণ করে। বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম ব্যাচ গতকাল সোমবার চীনের উদ্দেশে রওনা দেয়।

এ ছাড়া বেইজিংকে ভিন্ন আরেকটি প্রস্তাব দেয় ঢাকা। সেটি হলো বাংলাদেশে একটি উন্নতমানের হাসপাতাল তৈরি করে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ নতুন উদ্যোগ অনুযায়ী একদিকে বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসার জন্য চীনে যাবে, অন্যদিকে বাংলাদেশে তাদের সহায়তায় একটি বিশ^মানের হাসপাতাল তৈরি হবে। প্রধান উপদেষ্টার সফরে বিষয়টি আলোচনা হবে।

বাণিজ্যিক ইস্যু : বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। বিনিয়োগ, কৃষি, কানেকটিভিটি, পানি, জ্বালানি, প্রকল্প সহায়তা, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহযোগিতা রয়েছে দেশটির সঙ্গে। চীন থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ নেয়, তার সুদের হার তুলনামূলক বেশি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরেও বিষয় আলোচনায় এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার সফরেও এটি আলোচনায় থাকবে। চীনকে বিনিয়োগে আহ্বান করার প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাব করা হবে, চীনে যেসব সানসেট ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে, সেগুলোর একটি অংশ যদি বাংলাদেশে স্থাপিত হয়, তবে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে কৃষিতে আগ্রহী করতে চীনের কৃষিপ্রযুক্তির প্রতি বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত