মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

শুষ্ক মরুর বুকে যিনি বইয়ে দিলেন করুণাধারা

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কারণে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া অনেক সহজ হয়েছে। এই কিছুদিন আগেও অর্থাৎ দুইশ-আড়াইশ বছর আগেও হজ করতে যাওয়ার জন্য আমাদের দেশের মানুষকে কমপক্ষে এক বছর আগে যাত্রা শুরু করতে হতো। পথ ছিল অচেনা, বিপদসংকুল, বন্ধুর। কখনো হেঁটে, কখনো জাহাজে সেই পথ অতিক্রম করতে হতো। চোর-ডাকাত, লুণ্ঠনকারী-তস্করের ভয় তো ছিলই, তাদের হাতে সর্বস্ব হারানোর ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, কিন্তু এটিই শেষ না, যাত্রাপথে বিশেষ করে বিশাল মরুভূমিতে প্রয়োজনীয় খাবার ও পানযোগ্য পানির অভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। আর একবার পথ হারালে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। তবুও মানুষ স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজ করার জন্য জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে রওনা হতেন। এসব পুণ্যার্থী মানুষদের পথের কষ্ট ও যাত্রার দুর্ভোগ লাঘবের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেন অনেক মানবহিতৈষী। তারা পথে পথে খুলতেন লঙ্গরখানা, বিতরণ করতেন পানিযোগ্য পানি ও বিশ্রামের জন্য সরাইখানা। এই মানবহিতৈষীদের মধ্যে জুবাইদা বিনতে জাফর অন্যতম।

জুবাইদা বিনতে জাফর ছিলেন আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের রাজকন্যা এবং মিসরের খলিফা হারুনুর রশিদের রানী। সে সময়ে মিসর ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। সে সময়ের মিসরের কথা উঠে এসেছে বিখ্যাত সাহিত্য আলিফ লাইলা ওয়া লাইলাতেও। এই সাহিত্য কর্মেই উল্লেখ রয়েছে যে, খলিফা হারুনুর রশিদ সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা বা খলিফার কাছে তাদের প্রত্যাশা জানার জন্য নিজেই ছদ্মবেশে নগরে ঘুরে বেড়াতেন। তারই যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন জুবাইদা বিনতে জাফর। জুবাইদা নিজ কর্মগুণে সাম্রাজ্যের রানী বা খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রীর পরিচয়ের বাইরেও নিজের স্বকীয় পরিচয় সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তিনি নিজে ব্যবসাবাণিজ্য করতেন, সেগুলো পরিচালনার জন্য লোক নিয়োগ দিতেন এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের সাহায্য ছাড়াও নিজ অর্থে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন। তার প্রকৃত নাম আমাতুল আজিজ। জুবাইদা নামতি দিয়েছিলেন তার দাদা আল মনসুর। জুবাইদা শব্দের অর্থ ‘ছোট মাখন বল’। বোঝা যায়, দাদার অত্যন্ত আদরের ছিলেন বলেই এমন নামকরণ করেছিলেন তিনি। নিজ কর্মগুণে এই নামেই তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

জুবাইদা বিনতে জাফর ছিলেন অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও মানবদরদি। তিনি যখন হজ পালনের জন্য বাগদাদ নগরী থেকে রওনা দেন তখন দেখেন পথের কুয়োগুলোতে তেমন পানি জমতে পারছে না। সেগুলো নানাকারণেই অগভীর হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া পথে আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা তার নজরে এসেছিল। দীর্ঘ পথে কোথাও হয়তো নেই কোনো জলাধার আবার কোথাও পথের মধ্যখানে রয়েছে জলাধার, যে কারণে চলাচল হয়ে পড়েছে দুঃসাধ্য। হজযাত্রীদের পথের এমন দুরবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি অগভীর কূপ খননের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যেখানে জলাধার নেই সেখানে জলাধার খননের ব্যবস্থা করেন আর যেখানে পার হওয়ার সেতুর প্রয়োজন সেখানে সেতু তৈরির নির্দেশ দেন। তার বিশাল কর্মী বাহিনী তার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। বিশাল মরুভূমিতে পানির তল পাওয়ার মতো গভীর কুয়া খনন সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু প্রাকৃতিক বাধার মুখে পিছু হটার মানুষ ছিলেন না জুবাইদা। তিনি হজযাত্রীদের কল্যাণার্থে নিজের শেষ অর্থটিও খরচ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তার দৃঢ়তা ও অকৃপণ অর্থ জোগানের ফলে বাগদাদ থেকে মক্কা ও মদিনায় যাওয়ার পথে গড়ে ওঠে অসংখ্য জলাধার, কুয়া ও মানুষ পারাপারের সেতু। ফলে হজযাত্রীদের যাত্রাপথ হয় অধিকতর সহজ ও ক্লেশহীন।

জুবাইদা বিনতে জাফর তার দানশীলতা, সদিচ্ছা ও সৎকর্মের জন্য আজীবন মানুষের মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত