ছোট্ট আছিয়ার মৃত্যু বড়দের কাঁদিয়ে আর দেশটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। ওর ছোট্ট জীবনের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মমতার এই সংবাদ যারা পড়েছে, তাদের বুকে কাঁপন ধরেছে, প্রশ্ন জেগেছে মানুষ এত নিচ হতে পারে কীভাবে? যার কাছে স্নেহ পাওয়া আর আবদার করার কথা তার কাছ থেকেই ভাষায় প্রকাশ অযোগ্য লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের শিকার হলো মেয়েটা। নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন আর সহিংসতা শুধু ঘটেই চলেছে তাই নয়, বেড়েও যাচ্ছে দিন দিন। পথে চলতে বিড়ম্বনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবহনে এমনকি নিজের বাড়িতেও কি নিরাপত্তাহীন নয় মেয়েরা? তাহলে সমাজে মানুষের জীবন কি নিরাপদ হবে না? কেন ৫ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের নারী লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচতে পারে না। আর পোশাক! আপাদমস্তক আবৃত রেখেও কি নিরাপদ তারা? সমাজে সংঘটিত এসব অনিয়ম এবং অত্যাচার দেখতে দেখতে মানুষ কখনো নির্লিপ্ত হয়ে যায়। যখন দেখে এর হাত থেকে আর নিস্তার নেই তখন দায়ী করতে থাকে নিজেকেই। ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে বলে, ওই রাস্তা দিয়ে কেন গিয়েছিলে, পকেটে টাকা কেন রেখেছিলে, দামি মোবাইল ফোন নিয়ে বাইরে যাওয়ার কী দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েরা লাঞ্ছিত হলে যুক্তি করে, বাইরে কেন গিয়েছিল, পোশাক ঠিক ছিল তো, ছেলেদের সঙ্গে মিশে কেন ইত্যাদি। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো কোনো ঘটনার আঘাতে মানুষের সুপ্ত বিবেক জেগে ওঠে। ফুঁসে উঠে মানুষ আর প্রতিকার চায় তীব্রভাবে।
কিন্তু কোনো মর্মস্পর্শী ঘটনায় জেগে ওঠা মানুষগুলো আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে সমাজ আবার যথা পূর্বং তথা পরং নীতিতে চলতে থাকে। ফলে আন্দোলনের দাবিগুলো ভুলে যায়, সরকারও দায় এড়ানোর সুযোগ পেয়ে যায়। যেমন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে যে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের বিপুল প্রত্যাশা কি ফিকে হয়ে যাচ্ছে? এটা তো ঠিক অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে লোকচক্ষুকে ধোঁকা দেওয়ার মতো কোনো জাদুর চেরাগ নেই। জনগণ সেটা জানে, তাই প্রতীক্ষায় আছে এবং পর্যবেক্ষণ করছে। সরকার কোন কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, কোন বিষয়টি উপেক্ষা করছে তা নিয়ে কথা বলছে, সমাবেশ করছে, দাবি জানাতে উপদেষ্টাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। আশা একটাই, এই সরকার যেহেতু আন্দোলনের পটভূমিতে ক্ষমতায় এসেছে, ফলে তাদের কথা সহৃদয়তার সঙ্গে শুনবে। কিন্তু ধর্ষণের বিচার চাইতে যাওয়া আন্দোলনকারী, চাকরির স্বীকৃতি ও বেতনের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষকসহ বিভিন্ন অংশের মানুষের সঙ্গে যে দমনমূলক ভূমিকা পালন করল পুলিশ এবং প্রশাসন তা ইতিমধ্যে নতুন আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে থাকে, তারা কিছু কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা দাবি করেন, তাদের কথা স্পষ্ট। কিন্তু মানুষ দেখে কথাগুলো একই রকম, শুধু যারা এই কথা বলেন ব্যক্তিগতভাবে তারা আলাদা। যেমন এই দেশে সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। আইন সবার জন্য সমান, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না, কঠোর হাতে দমন করা হবে। দ্রব্যমূল্য আগের তুলনায় স্থিতিশীল আছে, খাদ্য সরবরাহে কোনোরকম ঘাটতি নেই। কোনো সিন্ডিকেট নেই, বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক, একটি চিহ্নিত মহল অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। বাজেটের সময় বলে, ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাজেট দেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটে এবং শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর রাজনৈতিক প্রশ্নে বলে, বিরোধী দল সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়। পত্রিকায় কোনো সমস্যা কিংবা সংকটের খবর এলে বলা হয়, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করুন। মোদ্দা কথা, সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেখলে মনে হয়, সব ঠিক আছে, যারা দেশের ভালো চায় না তারাই শুধু সংকট দেখে। ক্ষমতাসীনদের চোখে দেখলে এটা মনে হতেই পারে দেশের সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে।
সরকারের চোখ আর জনগণের চোখ যে এক রকম দেখে না, সেটা আন্দোলনের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। বাংলাদেশ এক অর্থে আন্দোলনের দেশ। বারবার আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান এ ধরনের আন্দোলনের সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ রূপের একটা দৃষ্টান্ত। ৫ আগস্ট পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের আগে সরকারের মুখে দেশের কোনো সমস্যা, জনগণের যৌক্তিক দাবির স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো কথা কি দেশবাসী শুনেছে? আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা আর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজয় যে জনসমর্থনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার কথাই তো শুনেছে দেশবাসী। নিয়মিত প্রচারিত হতো, বিরোধী দল বিদেশিদের সঙ্গে মিলে দেশের স্বার্থ ধ্বংস করছে আর ক্ষমতাসীন দল কীভাবে বিদেশিদের প্রশংসায় ভেসেছে। তারা যে কাজই করুন না কেন, সবই দেশের স্বার্থে। সেটা সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ফুলবাড়িয়ার হাজার হাজার বিঘা আবাদি জমি ধ্বংস করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা, প্রচুর ব্যয় এবং অপব্যয় করে মেগা প্রকল্প, যা কোনোদিন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক তো হবেই না বরং এর লুটপাটের দায় জনগণকে বহন করতে হবে বছরের পর বছর। এসবগুলোই জনগণকে চমক লাগিয়ে বোকা বানানো আর নিজেদের আখের গোছানোর প্রকল্প ছিল তা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই উন্নয়নের চমকে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করার প্রক্রিয়ার সুবিধাভোগী যেমন আছে, অসুবিধাভোগীরাও তেমন আছে। চরম অসুবিধা ভোগ করে শেষ পর্যন্ত জনগণ। খরচের জোগান দেয় তারা, বর্ধিত ব্যয়ের জন্য ভ্যাট ট্যাক্সের বোঝাও বহন করে তারা।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, সবসময় ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও নির্বাচন প্রশ্নে তাদের মতামত প্রায় একই রকম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসুক আর অন্য যে কোনোভাবেই তারা ক্ষমতায় আসুক না কেন, জনগণের ভোটাধিকারের প্রশ্নে তারা খুব সতর্ক। তারা বলেন, নির্বাচন দরকার, তবে সেটা হতে হবে তাদের সুবিধাজনক সময়ে এবং শর্তে। এ কারণেই জনমনে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে, ক্ষমতা কি কোনোভাবে আঁকড়ে থাকার ইচ্ছা আছে? নির্বাচন তখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ না হয়ে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতায় থাকার সিঁড়ি হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে পারলে প্রশাসন, পুলিশ ব্যবহার করতে পারে, টাকা-পয়সা জোগাড় করতে পারে, বিরোধী দলকে হয়রানি করতে পারে, ফলে নির্বাচন আর সুষ্ঠু হয় না। সে কারণেই সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের দাবির সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি উঠতে থাকে বারবার। আন্দোলনে উচ্চারিত দাবিগুলো সবসময় স্পষ্ট হতে হয়। তা না হলে আন্দোলনের নৈতিকতা থাকে না। যেখানে লাখ লাখ মানুষের স্বার্থ জড়িত, যে আন্দোলনের মধ্যে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি, যে আন্দোলন স্বপ্ন দেখায় ভবিষ্যতের, যে আন্দোলনে অংশ নিয়ে মানুষ জীবন এবং সম্পদ বিসর্জন দেয় তা নিয়ে কি ছিনিমিনি করা যায়? সম্পদ মানুষ তৈরি করে। ফলে সম্পদ ধ্বংস হলে আবার তা অর্জন করার সুযোগ এবং সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আন্দোলনে জীবন দিলে সেই জীবন কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? অথবা অঙ্গহানি হলে তা কি পূরণ করা যাবে? আন্দোলনে যারা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের সান্ত্বনা কী? যদি দেশটা ভালোভাবে চলে মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে। দুর্বৃত্তরা দেশের সম্পদ লুটপাট না করতে পারে, দেশের টাকা যেন পাচার না হয়ে যায়, ধর্ম বা জাতিগত নিপীড়ন যেন না হয়, নারীরা যেন নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক চলাফেরা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তাহলে একজন আন্দোলনে পঙ্গু হলেও সান্ত্বনা পাবেন এই ভেবে যে, তাদের প্রিয়জনের ত্যাগে দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। মৃতদের স্বজনরা কি এই ভেবে গর্ববোধ করবেন না যে, এই দেশের অগ্রগতিতে তাদের স্বজনের রক্ত আছে। সে কারণেই এবার যখন আহ্বান এসেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তখন জীবনের পরোয়া না করে ছাত্র শ্রমিক জনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কখনো কখনো অযৌক্তিক দাবিতেও কি আন্দোলন গড়ে ওঠে না? ওঠে, এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক আছে। মানুষ এতে দলে দলে যুক্ত হয়, বক্তার উত্তেজক বক্তব্যে বিক্ষোভে ফেটেও পড়ে। উত্তেজনার পারদ এত ওপরে থাকে যে, শ্রোতারা ভেসে যায় উত্তেজনায়। বক্তার কথার সত্যাসত্য বিচার করে দেখার মানসিকতা আর থাকে না। কথা শুনে শ্রোতার ভেতরে টগবগ করে ফুটতে থাকে রক্ত আর তাদের সামনে দাঁড় করানো হয় কল্পিত প্রতিপক্ষ। যাকে প্রতিপক্ষ বানানো হলো, সে কি আসল প্রতিপক্ষ, না কি আসল প্রতিপক্ষকে আড়াল করতেই এ ধরনের বক্তব্য, তা বোঝার সময় এবং ধৈর্য আর থাকে না। হাজার হাজার মানুষ তখন নেমে আসে পথে। আমাদের দেশের ইতিহাস হলো এই যে, যখন আন্দোলনে শ্রমিকরা যুক্ত হয়, নারীরা নেমে আসে, ধর্মীয় বিভাজনের সংকীর্ণ গণ্ডী ছেড়ে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়; তখন প্রশাসন, পুলিশ এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেও ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থাকতে পারে না। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান তার বড় প্রমাণ। ব্যবস্থা যদি বদল না হয় শুধু বন্দোবস্তকারী পাল্টে যায়, তাহলে মানুষের প্রত্যশা মার খায়। মানুষ দেখে যে, ব্যক্তিগুলো পাল্টে গেলেও দমন, দখল আর দুর্নীতি একই রকম থেকে গেল। শোষণ বৈষম্যের ব্যবস্থা বহাল রেখে দেশ পরিচালনা করলে এবং নারীর ওপর নিপীড়ন আর সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা বৃদ্ধির পরিবেশ যদি বাড়তে থাকে তখন মানুষ হতাশ হয়ে ভাবতে থাকে ভুল জায়গায় কি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম? গণমানুষের হতাশা কিন্তু সমাজের জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে। তাই ক্ষমতায় থেকে বক্তব্য দেওয়াই যথেষ্ট নয়, গন্তব্য নির্ধারণ করা জরুরি।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
rratan.spb@ gmail.com