বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

গুতেরেস-ইউনূসে চতুর্মুখী ম্যাজিক

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:১১ এএম

চার দিনের কর্মব্যস্ত সফর শেষে ঢাকা ছেড়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরে বরণ করেছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। আর রবিবার বিদায় জানান পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। বৃহস্পতিবার ঢাকা পৌঁছেই শুরু হয় আন্তোনিও গুতেরেসের কর্মব্যস্ততা। পরদিন শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সঙ্গী করে চলে যান কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দেখতে এবং তাদের সঙ্গে ইফতার করতে। এ সময়টায় সেরেছেন আরও অনেক কর্মযজ্ঞ। আরেক কর্মযজ্ঞে মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ চীন যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, এই সফর বাংলাদেশের চীন-সম্পর্কের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। এতে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হবে। হিসাব বা সমীকরণ এত সাদামাটা? আগে-পরে কি কোনো কথা নেই? নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, মার্কিন, চীন খুব প্রাসঙ্গিক। ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যও। গুতেরেসের বাংলাদেশ আর ইউনূসের চীন সফর  নিয়মতান্ত্রিক স্বাভাবিক সফর, নাকি পেছনে নানা কূটনীতি এ প্রশ্ন কূলকিনারাহীন। এর আগে, জুলাই-আগস্ট, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। পরে সংস্কারের পক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিবের সমর্থন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের অংশগ্রহণে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে আয়োজিত ইফতার মাহফিল, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের চীন সফরের সময় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক, ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ আইএসপিআরের সব মিলিয়ে বিরাট গোলকধাঁধা।

ধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ভঙ্গুর অর্থনীতিতে যারা মনে করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দেশি-বিদেশি চাপের মুখে পড়ছে; এমনকি সামরিক অভ্যুত্থানের মতো ঘটনার গুজবও ভেসেছে। এ রকম সময়েই সফরে আসা জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘টেকসই এবং ন্যায়সংগত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের ওপর নির্ভর করতে পারে।’ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য বাংলাদেশের জনগণ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে গুতেরেস বলেছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গণতন্ত্র, সুশাসন ও সমৃদ্ধি বিকাশের যে স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সঞ্চার হয়েছে জাতিসংঘ সেটাকে স্বীকৃতি জানায়। আরও বলেছেন, এই সময়টা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটি অংশগ্রহণমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের এই পথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত বাংলাদেশের পক্ষে তাদের প্রত্যাশিত ভূমিকাটি পালন করা। এত কথা বললেও একবারও নির্বাচনের তাগাদা দেননি গুতেরেস। বলেছেন সংস্কার হতে হবে, সংস্কার শেষে নির্বাচন হবে। এমনকি গোলটেবিল বৈঠকটি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হলেও, সেখানে ঐকমত্য কমিশনের মেম্বাররাও উপস্থিত ছিলেন। মিটিংটার আয়োজক কিন্তু ইউনূস নন, বরং এই মিটিং আয়োজন করেছে জাতিসংঘ নিজেই। ঘটনাটি সিগনিফিক্যান্ট। নইলে কেন বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ পর্বে রয়েছে মন্তব্য করে বলেছেন, বাংলাদেশের এই সন্ধিক্ষণে শান্তি, সংলাপ ও ঐকমত্যে সহায়তার জন্য জাতিসংঘ তৈরি আছে। চার দিনের বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় দিনে তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমি বাংলাদেশে আসতে পেরে আনন্দিত।  এও বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানানো। এর আগে, গুতেরেস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক চলাকালে বলেছেন, ‘আমি সংস্কার কর্মসূচির প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করতে চাই। আমরা আপনাদের সংস্কার প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য এখানে এসেছি। আমরা আপনাদের সর্বোত্তম সফলতা কামনা করি। যে কোনো সহযোগিতা লাগলে আমাদের জানান।’

জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যের মধ্যে অনেক উপাদান। তার এ বক্তব্য বাংলাদেশের সংস্কার প্রচেষ্টার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের বার্তা। প্রশ্নও অনেক। তার এ সফরে বাংলাদেশ কী পেল বা পাবে এ প্রশ্ন থাকাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘ মহাসচিবের কতটুকু শক্তি আছে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেই বা তারা কী করেছেন? গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে সে ধরনের বড় কোনো বিরোধ নেই। চিন্তার যে দূরত্ব তা নিজেরা আলোচনা করে নেওয়ার সুযোগ আছে। আর কোনো দল জাতিসংঘকে দূতিয়ালি করতেও ডাকেনি। তবে, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করতে, ফটোসেশন করতে কার আগে কে যেন ছুটে গেছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ গোলটেবিল ডেকে, প্রতিনিধি পাঠিয়ে কোন সমস্যা সমাধান করতে চায়? ইউনূসের সরকার কি সংস্কার ইস্যু ফোকাস করে জাতিসংঘকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ দিয়ে এক ধরনের সমঝোতার নামে নির্বাচন বিলম্বিত করে তার মেয়াদকাল বাড়িয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে? এর বিপরীতে জাতিসংঘের কর্র্তৃত্ব কতটুকু তা গাজা ইস্যুতে দেখা গেছে। আরও নানা ঘটনায় প্রমাণিত জাতিসংঘ মানে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরও তারা বাংলাদেশের জুলাই গণহত্যার বিচারকাজে সহায়তা করতে পারে। পলাতক সন্দেহভাজনদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারকাজে সহায়তা করতে পারে। সেই হিম্মত তাদের আছে।  বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার অন্যতম বৃহত্তম অবদানকারী দেশ উল্লেখ করে গুতেরেস বিশ্বে সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন ও সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে ইফতার করার কথাও উল্লেখ করেন। এর মাধ্যমে তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশিদের প্রতি তার সংহতি প্রকাশ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এ তথ্যটি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সফরকালে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বৈঠকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান, আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার প্রশংসা করেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় সেনাপ্রধান বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ ও জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জানান, ‘বাংলাদেশ শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

সফরের অংশ হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন একটি বিশেষ ঘটনা। সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, শরণার্থী ইস্যু ব্যবস্থাপনা খুব সংবেদনশীল বিষয়। শেখ হাসিনা বলতেন তার বোন তাকে বলেছে ১৬ কোটি মানুষকে যখন খাওয়াতে পারো, ১০-১১ লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়াতে পারবে না কেন? তাদের মাথা-মগজে একটি আমিত্ব চিন্তা ঢুকে পড়েছিল যে, তারাই এদেশের মানুষকে খাওয়ান, পরান। আবার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক ধরনের জগদ্দল চিন্তা ভর করেছিল। তারা কেবল সরকারের ওপর দায় চাপিয়েছে। আর শেখ হাসিনার সরকারের মনমর্জি ছিল, সমস্যা সমাধান করতে পারলে একটা নোবেল যদি আসে। শরণার্থী ইস্যুতে আবেগের চেয়ে বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা গুরুত্ব পায়নি। ইউনূস সরকার সেখানে ব্যতিক্রম। গুতেরেসকে গ্রামীণ চেক পরিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া, পাঞ্জাবি পরিয়ে ইফতার করানোসহ তার প্রতিটি আয়োজনে সুপার ডিপ্লোমেসি কাজ করেছে। তার আসন্ন চীন সফরও অবশ্যই আরেক ডিপ্লোমেসি। বাহ্যত চীনের সঙ্গে একটা হেলথকেয়ার হেলথ সার্ভিসের যোগাযোগ বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। চীনের কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশে ব্যবসা স্থাপন করে, সেই লক্ষ্যও আছে। চীন সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পিকিং ইউনিভার্সিটিতে ড. ইউনূসের একটি বক্তৃতা দেওয়া। বক্তব্যটি রাখবেন সেখানকার বাংলাদেশি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে। পিকিং ইউনিভার্সিটি চীনেই নয়, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত এবং প্রায়ই বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষ দশে থাকে। প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরে হাইটেক পার্ক পরিদর্শন করবেন, যেখানে চীন বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে সোলার প্যানেল উৎপাদন এবং চিপ প্রযুক্তিতে। এখানে চীনের বর্তমান প্রযুক্তি খাতের সাফল্য এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এরইমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম সোলার প্যানেল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লঙ্গি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। বিশ্বের সোলার প্যানেল উৎপাদনের ৭০ শতাংশের বেশি তৈরি করে, বাংলাদেশে তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট স্থাপন করবে, যা দেশের সোলার সেক্টরে বিপ্লব আনতে সহায়ক হবে। ড. ইউনূসের সফর নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। তার মতে, এটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফর, যা বিগত ৫০ বছরে কখনোই দেখা যায়নি। সামনে তাহলে আর কী দেখার থাকতে পারে? দেখার কী অবশিষ্ট আছে?

লেখকঃ সাংবাদিক-কলামিস্ট  ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত