বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চীনের সামনে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কেউ নেই

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ০২:১৫ এএম

সফট পাওয়ার হচ্ছে, বলপ্রয়োগ ছাড়াই নিজের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতা। আর হার্ড পাওয়ার হচ্ছে, সামরিক শক্তি তথা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কার্যসিদ্ধি। নরম ক্ষমতা ও শক্ত ক্ষমতা সম্পর্কে এমনটাই তথ্য দিচ্ছে কলিন্স ডিকশনারি। আভিধানিক অর্থ অন্বেষণ বাদ দিয়ে বিশ্বমিডিয়ার বিশ্লেষণ দেখলে চোখ কপালে ওঠে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে দেখা যায়, বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়ই সামরিক শক্তির আকারে তাদের হার্ড পাওয়ার তথা কঠোর শক্তি প্রদর্শন করে। কিন্তু সফট পাওয়ার তথা নরম শক্তির ক্ষেত্রেও তারা প্রতিযোগিতা করছে। সাম্প্রতিক গবেষণা তেমনটিই বলছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড ফিন্যান্স ২০২৪ সালে যে তথ্য প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, সফট পাওয়ারে এক নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র। তৃতীয় অবস্থানে ছিল চীন। কিন্তু সেই সূচকেই ২০২৫ সালে এসে বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখা যায়। চীন সফট পাওয়ার প্রভাবের ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয়। তার সামনে এখন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউএসএআইডির ওপর ট্রাম্পের আক্রমণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের সফট পাওয়ারের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই অঞ্চল থেকে ওয়াশিংটনের পিছু হটা এমন একটি স্থান ছেড়ে দিয়েছে যা বেইজিং লুফে নিতে পারে।

ব্র্যান্ড ফিন্যান্সের ২০২৫-এর সফট পাওয়ার সূচকে জানা যায়, গত বছর চীন ব্র্যান্ড হিসেবে আটটি সফট পাওয়ার স্তম্ভের মধ্যে ছয়টি এবং পরিমাপযোগ্য বৈশিষ্ট্যের দুই তৃতীয়াংশে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এর মানে আর্থিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে চীন। ফলে বৈশ্বিক মর্যাদাক্রমেও তার অবস্থান ২৭-এ চলে এসেছে। ২০২১ সালেও যা ছিল ৫৬তম। গবেষণায় বলা হয়, ব্যবসা এবং বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্যের কারণে চীনের অর্থনৈতিক শক্তি, উদ্ভাবন এবং বিশ্ববাজারে একীভূতকরণের ক্ষমতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ‘ব্যবসা সহজ করার’ ক্ষেত্রে ২০২০ সাল থেকে চীন বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৫ সালের সূচক অনুযায়ী ‘শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি’র জন্য চীন অষ্টম।

চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা মূলত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো উদ্যোগের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীনা কোম্পানির বাজার সৃষ্টি এবং আর্থিক সম্পর্ককে মজবুত করে। এর ফলে ‘অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক’ সূচকে চীনের অবস্থান এক লাফে ২৪-এ এসেছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ মূলত দুই হাজার বছর আগে চীনের জিয়ান প্রদেশ থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে বাণিজ্যিক পথ গড়ে উঠেছিল, তার আধুনিকতম সংস্করণ। তখন এটি ‘রেশম পথ’ বা ‘সিল্ক রোড’ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে গড়ে ওঠা এই সিল্ক রোড দশম শতাব্দীতে বন্ধ হয়ে যায়। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই পথটিকে আরও বড় পরিসরে নির্মাণ করতে চান। সফট পাওয়ার অর্জনের ক্ষেত্রে যে কাজগুলো করতে হয় সেগুলো হলো ব্যবসায় অন্যকে যুক্ত করার যোগ্যতা, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা। এর মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করে বিশ্ব মঞ্চে নিজের পদক্ষেপকে আরও সুদৃঢ় করা। কৌশলগত বিনিয়োগের ফলে বিশ্বদরবারে এখন চীনা ব্র্যান্ডের গুরুত্ব বেড়েছে।

২০২৫ সালে ‘বিশ্বের ভালোবাসার পণ্য এবং ব্র্যান্ড’ হিসেবে চীন পঞ্চম হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যের উত্থান মূলত দেশীয় এবং বিশ্বব্যাপী চীনা ব্র্যান্ডগুলোর ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি এবং কর্মক্ষমতার কারণে। গত ১৭ বছরে, ব্র্যান্ড ফাইন্যান্স গ্লোবাল ৫০০-এ চীনা ব্র্যান্ডের সংখ্যা ১৩ থেকে বেড়ে ৬৮-এ দাঁড়িয়েছে। সেইসঙ্গে তাদের মোট ব্র্যান্ড মূল্য ২৩ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

এই উন্নয়ন দেশীয় আধিপত্য থেকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড নেতৃত্বের দিকে স্থানান্তরকে প্রতিফলিত করে। যার উদাহরণ টিকটকের মতো চীনা ব্র্যান্ডের বিশ্বব্যাপী প্রভাব। এক বিলিয়নেরও বেশি মাসিক ব্যবহারকারীর সঙ্গে টিকটক বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে। এর প্রভাব সম্ভবত মিডিয়া এবং যোগাযোগের স্তম্ভে চীনের উন্নত কর্মক্ষমতায় অবদান রেখেছে, ‘যোগাযোগ সহজ’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ২০ ধাপ এবং ‘বিশ্বস্ত মিডিয়া’ থাকার জন্য চীন ১৩ ধাপ ওপরে উঠে এসেছে। তিন বছর ধরে ‘প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে উন্নত’ হওয়ার জন্য চীন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে। এই অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী টেলিযোগাযোগের শীর্ষস্থানীয় হুয়াওয়ে এবং নতুন শক্তির যানবাহন নির্মাতা বিওয়াইডি-এর মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের উত্থানের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, যা বিশ্বকে বৈদ্যুতিক যানবাহনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আরেকটি উদাহরণ হলো, স্টেট গ্রিড করপোরেশন অব চায়না। যা বিআরআই-তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী চালকের আসনে আবির্ভূত হয়েছে। এসজিসিসি অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিকাশ ও পরিচালনা করে চীনের বিদেশি জ্বালানি কর্মসূচিগুলোকে শক্তিশালী করেছে এবং জ্বালানি উদ্ভাবন এবং টেকসই উন্নয়নে শীর্ষ পর্যায়ে থেকে নিজের ব্র্যান্ডকে শক্তিশালী করেছে।

চীনা জনগণ মূল্যবোধের স্তম্ভের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিভিন্ন গুণাবলির ক্ষেত্রে র‌্যাংকিং রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন ‘উদার’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য ২৭ ধাপ, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ হিসেবে ২৫ ধাপ, ‘মজাদার’ হিসেবে ১৫ ধাপ এবং ‘বিশ্বস্ত’ হিসেবে ১২ ধাপ এগিয়েছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে তুলে ধরে। ‘ভ্রমণের জন্য দুর্দান্ত স্থান’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য চীন ছয় ধাপ এগিয়েছে এবং ‘আকর্ষণীয় জীবনধারা’ হিসেবে সাত ধাপ এগিয়েছে। এসব অর্জন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্তম্ভে চীনকে সপ্তম স্থানে উন্নীত করতে সাহায্য করেছে। তারা দেশের বৃহত্তর নরম শক্তি উদ্যোগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। যাতে তারা তার সাংস্কৃতিক আকর্ষণ এবং প্রভাব উপস্থাপন করতে পারে এবং বিশ্ব মিডিয়ার কাছে চীনের জাতীয় ব্র্যান্ডকে সর্বোত্তমভাবে উপস্থাপন করতে পারে। এই ধরনের উদ্যোগ আগামী বছরগুলোতে চীনের শক্তি আরও বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

(চায়না ডেইলি অবলম্বনে)

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত