দিন দিন বদলে যাচ্ছে কানাডার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। রাজনীতিতে মার্ক কার্নির নাম নতুন সংযোজন হলেও কানাডার অর্থনীতিতে তার অবদান উল্লেখ করার মতো। তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত বছর এমনকি চলতি বছরের শুরুতে মার্ক কার্নি লিবারেল পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত কানাডিয়ানদের মধ্যে এ ধারণা প্রোথিত ছিল যে, কনজারভেটিভ পার্টি পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে এবং কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়লিয়েভ হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাস্টিন ট্রুডো’র পদত্যাগের পর দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মার্ক কার্নি। তখনই পাল্টে যায় কানাডার রাজনীতি।
মার্ক কার্নি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে না নিতেই লেবারেল পার্টিকে জয়ের ধারায় ফিরিয়ে এনেছেন। সর্বশেষ কানাডার মিডিয়ার জনমত জরিপে তাই মনে হচ্ছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সব দলের জনমত জরিপে লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা নিচে এসে পৌঁছে যায়। কনজারভেটিভ পার্টির ক্ষমতায় যাওয়াটা নিশ্চিত কিংবা পিয়েরে পয়লিয়েভ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এ বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন কানাডিয়ানরা। বিষয়টি সবগুলো জনমত জরিপে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছিল। শুরুতে খুব সামান্য ব্যবধানে মার্ক কার্নি পিছিয়ে থাকলেও সর্বশেষ ১৮ মার্চ যে কয়েকটি জনমত জরিপ হয়েছে, তার সব কয়টি জরিপে দেখা গেছে, কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়লিয়েভ মার্ক কার্নির চেয়ে পিছিয়ে গেছেন। ‘আজ কানাডায় যদি ভোট হয় তাহলে আপনি কাকে ভোট দেবেন’ এ রকম একটি প্রশ্ন নিয়ে যে জনমত জরিপ হয়েছে তাতে অন্তত প্রধান তিনটি জরিপে দেখা গেছে লিবারেল পার্টির অবস্থান ৪২.৩ শতাংশ অপরদিকে কনজারভেটিভ পার্টি ৩৮.৪ শতাংশ এবং এনডিপি ৮.১ শতাংশ, ব্লক কুইবেক ৬.৮ শতাংশ। অথচ একমাস আগেও লিবারেল পার্টি কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। সেটা অতিক্রম করে মার্ক কার্নি এখন এগিয়ে রয়েছেন। ফলে পিয়েরে পয়লিয়েভের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বাদ কিংবা কনজারভেটিভ পার্টির ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না।
অন্যদিকে আরেকটি জনমত জরিপে বলা হয়েছে, কানাডার পার্লামেন্ট যে ৩৪৩টি আসন বর্তমানে রয়েছে সে আসনে যদি আগামীকালই ভোট হয় তাহলে লিবারেল পার্টি ১৭২ থেকে ১৯৫টি আসন পেতে পারে। কনজারভেটিভ পার্টি ১২২ থেকে ১৪৪টি আসন পাবে। অর্থাৎ জনমত জরিপ ইঙ্গিত করছে, মার্ক কার্নির নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এ দিকে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকা ও কানাডার মধ্যে শুরু হয়েছে শুল্ক বাণিজ্য যুদ্ধ। যেখানে আমেরিকা ও কানাডার বর্ডারে প্রতিদিন গড়ে ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সীমান্ত পারাপার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪টি অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে টপ এক্সপোর্ট ডেস্টিনেশন হচ্ছে কানাডা। আমেরিকা ও কানাডার বাণিজ্যযুদ্ধে কানাডা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকার ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ব্যবস্থা নেওয়ার। ফলে দুই দেশের নাগরিকরাই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এমন পরিস্থিতিতে, মার্ক কার্নি লিবারেল পার্টির নতুন নেতা হিসেবে ইতিমধ্যে যেসব পলিসির ঘোষণা দিয়েছেন, সেগুলো সমর্থন পেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই আগ্রাসী হয়ে উঠছেন এবং তার বিরুদ্ধে মার্ক কার্নির বক্তব্য, লিবারেল পার্টির অবস্থান জনগণের আস্থা বাড়িয়ে দিচ্ছে লিবারেল পার্টির প্রতি। ফলে সমর্থনও বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং সামনের দিনগুলোতে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মোকাবিলায় মার্ক কার্নি যে যোগ্য ব্যক্তিত্ব, পিয়েরে পয়লিয়েভ নন এ ব্যাপারটি কানাডিয়ানরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। ফলে মার্ক কার্নির নেতৃত্বেই লিবারেল পার্টির আবার সরকার গঠন করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়লিয়েভের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘পিয়েরে পয়লিয়েভের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি হইচই করেন, কেওয়াজ করেন বেশি, তিনি সাউন্ড বাইট।’ কিন্তু কানাডার বর্তমান পরিস্থিতিতে যে অর্থনৈতিক জ্ঞান থাকা দরকার, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিয়েরে পয়লিয়েভের মধ্যে তার ঘাটতি রয়েছে। মার্ক কার্নি বলেন, আমি সামনে যে বিষয়টি তুলে ধরতে চাই, সেটা হচ্ছে কানাডিয়ানরা কি একজন অর্থনৈতিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বিবেচনায় নেবেন, নাকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একজন ইনকমপিটেন্ট ব্যক্তিকে বিবেচনায় নেবেন? অন্যদিকে আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়লিয়েভ ঘোষণা দিয়েছেন, তার নির্বাচনী প্রচারণা যখন শুরু হবে সেই প্রচারণায় কোনো সাংবাদিককে সঙ্গে নেবেন না। অর্থাৎ কানাডার প্রচলিত নিয়মে ফেডারেশন বা প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে পার্টির যিনি নেতা, তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায় সফরসঙ্গী হিসেবে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানান এবং পার্টির নেতা যখন সফর করেন তার সঙ্গে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এবার পিয়েরে পয়লিয়েভ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি তার সঙ্গে কোনো সাংবাদিককে নেবেন না এবং তার ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এবার পিয়েরে পয়লিয়েভ সঙ্গে কোনো সাংবাদিক নেবেন না। কনজারভেটিভ পার্টি জানিয়েছে, তাদের যতগুলো পাবলিক ইভেন্ট থাকবে সেই ইভেন্টগুলো সাংবাদিকরা চাইলে তাদের মতো করে কাভার করতে পারবেন, অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সেটা কনজারভেটিভ পার্টি উৎসাহিত করে কিন্তু তারা তাদের গাড়িতে করে কোনো সাংবাদিককে সঙ্গে নেবেন না। তবে তারা এটাও বলছে যে, যখন যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে তা যেন স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে সব সাংবাদিক পেতে পারেন সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করব। তবে আমরা সঙ্গে কোনো সাংবাদিককে নেব না।
লিবারেল পার্টি ও এনডিপি পার্টি নিশ্চিত করেছে, তারা বরাবর তাদের নেতার সঙ্গে যেভাবে সাংবাদিকরা যেতেন, এবারও তারা সেই প্রথা চালু রাখবেন। ফলে লিবারেল পার্টির নেতা মার্ক কার্নি ও এনডিপি নেতা জাগমিত সিং যখন নির্বাচনী প্রচারণায় যাবেন, তাদের সফরসঙ্গী হিসেবে সাংবাদিকরা যেতে পারবেন। শুধু পিয়েরে পয়লিয়েভের সঙ্গে সাংবাদিকরা যেতে পারবেন না। যদি কেউ যেতে চান তাদের আলাদাভাবে যেতে হবে, তাদের নিজ খরচে। কনজারভেটিভ পার্টির ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন অফিস থেকে বলা হয়েছে, ট্রাভেলসহ অন্যান্য সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। খরচ কমাতে হবে তবে আমরা নিশ্চিত করছি, সাংবাদিকরা যেন সব তথ্য যথাযথ সময়ে পেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ব্যাখ্যার ব্যাপারে খুব বেশি যে কনভিন্স হচ্ছেন তা নয়। তারা বলছেন, প্রায় এক বছর ধরে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ভাবতে শুরু করেছিলেন। মার্ক কার্নি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পিয়েরে পয়লিয়েভ বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছেন। তা না হলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ঠিক নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কেন? অন্যদিকে কানাডার স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার মার্ক কার্নি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগামী ২৮ এপ্রিল অথবা ৫ মে কানাডার পরবর্তী ফেডারেল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এমন একটি খবর কানাডার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেন, কানাডার অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী রূপ দিতে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঠিক রাখতে এই মুহূর্তে একটি শক্তিশালী সরকার দরকার। সেই কারণেই নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। কানাডার নির্বাচনের আইন অনুসারে ফেডারেল নির্বাচনের আগে প্রচারণার জন্য কমপক্ষে ৩৬ দিন সময় দেওয়ার বিধান রয়েছে। কানাডার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ফেডারেল নির্বাচনে ৩৪৩টি আসনের মধ্যে আসনভিত্তিক যে জনমত জরিপ সেখানে লিবারেল পার্টি ১৮০ থেকে ১৯১ আসন, অন্যদিকে কনজারভেটিভ পার্টি ১২৪ থেকে ১৪১টি আসন পেতে পারে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠনের জন্য ১৭২টি আসন দরকার হয়। অর্থাৎ লিবারেল পার্টির প্রতি কানাডিয়ানদের আস্থা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু দুই মাস আগেও লিবারেল পার্টি কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় অনেক পেছনে ছিল।
কানাডার রাজনীতিতে ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, এই মুহূর্তে কানাডার প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়ন। মাল্টিকালচারের দেশ কানাডায় বিগত কয়েক বছরে প্রচুর সংখ্যক নতুন অভিবাসী আসায় দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, কানাডার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়াসহ জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়া, কানাডার সরকারের পদক্ষেপে একের পর এক ক্রমাগত নতুন অভিবাসীর আগমনের ফলে ট্রুডো সরকার ইতিমধ্যেই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে যার ফলে জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগ করেছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লিবারেল পার্টির নেতা এমন একজনকে হতে হবে, যার অর্থনীতির ওপরে দক্ষতা রয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মনের ভাষা যিনি বোঝেন। তখনই কানাডার অর্থনীতি আবার সচল হবে। কানাডা আগের অবস্থানে ফিরে আসবে এমন নেতা নির্বাচন জরুরি। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীল রাখা এবং ট্রাম্পের সঙ্গে ট্যারিফ নিয়ে কানাডা ও আমেরিকার যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার সমাধান এই মুহূর্তে মার্ক কার্নির বিকল্প অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের মধ্যে নেই। এমন ধারণাই দিন দিন মার্ক কার্নির দল লিবারেল পার্টিকে, জয়ের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনের ফল, এখন প্রত্যক্ষ করার পালা। দেখা যাক!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট ক্যালগেরি, কানাডা