কানাডার আলবার্টা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ঘাদা আগিল, যিনি একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী, গত বছরের শেষ দিকে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি শেক্সপিয়ারের নাটকের একটি বিখ্যাত সংলাপের উদ্ধৃতি দেন, ‘পৃথিবী একটি রঙ্গমঞ্চ’। ফিলিস্তিনি এই নারী অধ্যাপক তার লেখায় আক্ষেপ করেছেন এভাবে পৃথিবী এত বিশাল রঙ্গমঞ্চ! অথচ গাজাবাসীর জন্য একটু জায়গা নেই!
আগিলের আক্ষেপ সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত নয়, বরং কয়েক যুগের বঞ্চনার গল্প। সম্ভবত গাজা বা পশ্চিম তীরের মানুষ মানবীয় অধিকারের বাইরে বিরাজ করেন। তারা যাযাবর না হয়েও যাযাবর। তাদের জন্য পৃথিবীতে নিরাপদ আবাস যেমন নেই। তাদের উপর্যুপরি মৃত্যুর হিসাব রাখার কোনো খেরোখাতাও এখন পৃথিবীবাসীর কাছে নেই। আগিল ওই লেখার যে শিরোনাম করেছিলেন, সেটির সারকথা ‘গাজাবাসী খবরের শিরোনাম থেকে হারিয়ে যাবে, তবুও গণহত্যা থামবে না।’ সত্যি সত্যি, গাজার গণহত্যা চলমান থাকলেও গণহত্যার সংবাদ গণমাধ্যমের বারোয়ারি খবরের তলানিতে। মানুষকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ কারও বিকার নেই। সবচেয়ে আশ্চর্য ও পরিতাপের বিষয় হলো, অর্ধলক্ষ মানুষকে হত্যার ঘটনা দেখার পাশাপাশি এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এখনো বিরাজ করছে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার; বলাবাহুল্য খোদ জাতিসংঘ। কী বৈপরীত্যের দুনিয়া!
বলার অপেক্ষা রাখে না যে ফিলিস্তিন সংকট পৃথিবীর মানুষের সামনে অবিচার-লাঞ্ছনার এমন সব নজির সৃষ্টি করেছে, যার সবই আধুনিক সভ্যতার রীতিনীতির পরিপন্থী। সব অস্বাভাবিকই যেন স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। যেমন- ইসরায়েল নামের খোদ রাষ্ট্রটি একটি অস্বাভাবিক সত্তা হয়েও টিকে রয়েছে। এ রাষ্ট্রটির না ছিল জনসমষ্টি, না ছিল অখণ্ড ভূমি, না ছিল স্বাধীনতাবাদী কোনো সংগ্রামমুখর ঘটনাপ্রবাহ। পরাশক্তিদের খামখেয়ালি আর খবরদারিই এ রাষ্ট্রের আগাগোড়া ভিত্তি। সম্পূর্ণ অবৈধ ও অযাচিতভাবে প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন পরিপূর্ণভাবে রীতিসিদ্ধ। দখলদারির ওপর দাঁড়িয়ে টিকে যাওয়া সত্তা এখন স্থিতিশীল এক ব্যবস্থা। পরাশক্তিদের সামরিক সহায়তায় বলীয়ান মানবতাবিরোধী এক ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো রক্তপিপাসু শাসকদের হাত ধরে এ রাষ্ট্র স্মরণকালের ভয়াবহতম বর্বরতাকে কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে, একগুচ্ছ ডানপন্থি রাজনীতিকদের বাড়বাড়ন্তের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার ওপর দাঁড়িয়ে অন্যের অধিকার লুণ্ঠন ইসরায়েলের রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। জবরদস্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রকাঠামোটা, যার সমগ্র পরিসরটাই বর্ণবাদী। দুনিয়ার বুকে প্রতিটি দেশেরই একটি সার্বভৌম মানচিত্র থাকে; অথচ ইসরায়েলের তা নেই। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ভূমিকে অবলীলায়-নিঃসঙ্কোচে দখল করে নিচ্ছে জায়নবাদী শাসকরা। এতসব অস্বাভাবিক ঘটনাবলিই এখন স্বাভাবিক।
ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যার এ স্বাভাবিকীকরণও ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত এক স্থিতিতে পরিণত হয়েছে। গাজা উপত্যকায় ফের শুরু হওয়া ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসন নতুন কোনো রূপকল্প নয়; বরং যা ঘটছে, তা ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলে আসা অব্যাহত গণহত্যার বর্ধিত সংস্করণ মাত্র। সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের আগের পশ্চিম তীরে এমন কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেদিন ইসরায়েলি বাহিনী একজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেনি। গাজার মাধ্যমে গণহত্যা স্বাভাবিকীকরণের নতুন রূপ দেখা গেল। গণমাধ্যম, বিশ্ববাসী, আন্তর্জাতিক সংস্থা সবার কাছে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যাজনিত অপমৃত্যু ‘নিছক মৃত্যু’র বেশি কিছু নয়। ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ব্যথা-বেদনা বা মর্মপীড়া ভেদ করতে কার্যত ব্যর্থ। এসব মৃত্যু সয়ে যাওয়া ঘটনায় রূপ নিয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলো মৃত্যুর ধারাবিবরণী দিচ্ছে মাত্র।
...
১৯৪৮ সালের ১৪ মে পরাশক্তিদের মদদে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরদিন সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, যাকে ঐতিহাসিক ‘নাকবা’ তথা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে ফিলিস্তিনিরা। আন্তর্জাতিক কোনো গোষ্ঠী এ অন্যায়ের কোনো জবাবদিহি আদায় করতে পেরেছে আজ পর্যন্ত? পারেনি। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর গোটা পশ্চিম তীর দখলে নিয়ে সেখানে অবৈধ দখলদারির মাধ্যমে ইহুদি বসতি চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু সমালোচনা করেই দায় সেরেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা তারা নিতে পারেনি, যা তেলআবিবকে নিবৃত্ত করতে পারে। গাজায় অব্যাহত গণহত্যার মধ্যেও সেখানে বসতি স্থাপন, জমি দখল চালিয়ে আসছে ইসরায়েলের ডানপন্থি সরকার। এমনকি ইসরায়েলের বিচারব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে এসব অন্যায়কে ‘অন্যায়’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বিচারিক কাঠামোতে নেই। ১৯৯৩ সালে ‘অসলো চুক্তির’ মধ্য দিয়ে দুই রাষ্ট্র সমাধানের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা ইসরায়েল যেমন ভুলে গেছে, বিশ্ববাসীকেও ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র বিরাজ করার সম্ভাব্য বাস্তবতা এখন আর নেই। তারা বিশ্বাসই করতে চায় না, তাদের পাশে ফিলিস্তিনিদেরও রাষ্ট্রসত্তা অর্জনের অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রসত্তা অর্জনের এ দাবি নস্যাৎ করতে জায়নবাদী তাত্ত্বিক ও পশ্চিমা ব্যবস্থা শুরু থেকেই তৎপর ছিল। সেজন্য ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র হেন কোনো অপরাধ নেই, যা করেনি। ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের ভূমির অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার; এমনকি মানবাধিকারও অবহেলিত। এসব ঘটনার পরিণতিতে দেশটির রাজনৈতিক পরিসরে উগ্র ডানপন্থার সমাবেশ যেন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ‘অমানবিক এক যুদ্ধযন্ত্রে’ পরিণত করেছে। এ পর্যন্ত ইসরায়েল গণহত্যা, জাতিগত নিধন, বাস্তুচ্যুতির মতো যত যুদ্ধাপরাধমূলক কাজ করেছে; তার কোনোটি নিয়েই কোনো জাবাবদিহির আওতায় পড়তে হয়নি তেলআবিবকে। দেশটির শাসকরা এ জন্য কোনো অন্যায় করতে ন্যূনতম দ্বিধাবোধ করে না।
...
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলার পর ইসরায়েল গাজা উপত্যকা জুড়ে নানা যুদ্ধাপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির পর চুক্তি ভঙ্গ করে তেলআবিবের আক্রমণের পন্থা পুরনো ও চিরাচরিত যুদ্ধাপরাধমূলক তৎপরতার ধারাবাহিকতা মাত্র। বেসামরিক জনগণকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা, গাজার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বাসিন্দাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি শরণার্থী তাঁবুগুলোকে লক্ষ্য করে নারকীয় আক্রমণে হাজার হাজার নারী-শিশুর প্রাণ নিঃশেষ হওয়া অব্যাহত রয়েছে। হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলো ইসরায়েলের গোলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার চিকিৎসা স্থাপনা, শিক্ষা অবকাঠামো থেকে জরুরি পরিষেবামূলক কোনো কিছুই অক্ষত নেই। লাখ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবন ব্যাহত। তাদের শৈশব-কৈশোরের বিকাশ ভয়াবহ অনিশ্চয়তায়। এসব নিরপরাধ শিশুর ভোগান্তির কারণ ইসরায়েলি জিঘাংসা। এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য জাতিগত নিধনের প্রকল্পকে বাস্তবায়ন। শুধু কি তাই! গাজার যুদ্ধক্লান্ত বেসামরিক মানুষ যাতে খাদ্য-ওষুধ সহায়তা না পেতে পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে বাধা দিয়ে আসছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসন। যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন আক্রেমণে গাজার শিশুদের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ আবারও উঠে আসছে নানা গণমাধ্যমে। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে এসব স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ। দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা এসব অন্যায়-অবিচারের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা বস্তুত শূন্য। বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গড়ে ওঠা জাতিসংঘ থেকে শুরু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এবং পরাশক্তিদের নানা ফোরাম এসব গণহত্যা প্রতিকারের দায় অনুভব করতে ভুলে গেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দুটি বড় আদালত ইসরায়েলকে যতবার থামাতে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রভাবশালী কয়েকটি পশ্চিমা মিত্র তাতে বাধা দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের ত্রাতা হয়ে বারবার দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে, সারা পৃথিবীর প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ গণহত্যার খবর এখন গুরুত্বহীন। বিশ্বরাজনীতির এজেন্ডায় গাজা এখন নিছক একটা নিত্যদিনের বুলেটিন। এত এত মানুষের মৃত্যু শুধুই সংখ্যা গণনায় দায় মেটানো। সামগ্রিকভাবে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা এক সংকট এটি।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ সম্প্রতি এক ভিডিওবার্তায় বলছেন, গাজাবাসী যদি হামাসকে তাদের কাছ থেকে আলাদা না করে তবে বেসামরিক জনগণকে তার জন্য মূল্য দিতে হবে। এ ধরনের হুমকি এবং হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর থেকে ক্রমাগত এ ধরনের অপরাধ ঘটতে দেখা গেছে। গাজার মানুষের ত্রাণ আটকে দেওয়া ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ঢুকতে বাধা দেওয়া যেকোনো বিচারে তদন্ত ও বিচারযোগ্য। কিন্তু আজ অবধি এসব অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করতে পারেনি আন্তর্জাতিক আদালত। ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধের নাম করে বেসামরিক মানুষদের ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’-এর আওতায় ফেলেছে। পানি-বিদ্যুতের ব্যবস্থা বন্ধ করেছে। একে কোনোভাবেই যুদ্ধ বলা যায় না। যা চলছে, তা পরিকল্পিত ও কাঠামোগত উপায়ে পরিচালিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের প্রকল্প। চতুর্দিক দিয়ে, সর্বশক্তি দিয়ে, সব ঘৃণ্য কৌশল প্রয়োগ করে ২২ লাখ অধিবাসীর জনপদকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এই প্রয়াস দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে নজর ঘুরিয়ে রয়েছে, তা নৈরাজ্যপূর্ণ প্রাচীন ব্যবস্থাকে হার মানানোর মতো। একে বলা যায়, আধুনিক মাৎস্যন্যায়।
লেখক: বিশ্লেষক ও অনুবাদক