বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

গুরুত্বপূর্ণ সফরে চীন যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৬:১০ এএম

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় আট মাসের মাথায় প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীনে যাচ্ছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে তার চার দিনের চীন সফর। এ সফরকে ঢাকা-বেইজিং মাইলফলক সফর হিসেবে দেখছে। বিশ্বব্যাপী এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চলমান পরিস্থিতিতে এ সফর নতুন বার্তা দিচ্ছে। সফরের তৃতীয় দিন ২৮ মার্চ বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের।

গতকাল মঙ্গলবার চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনেও এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে প্রধান উপদেষ্টার চীন যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটা বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ সফরে সাত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরাও এ সফরকে তাৎপযপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে গন্তব্য হিসেবে চীনকে নির্বাচিত করাটাই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তারা মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার এ সফর ভূরাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হবে। কেউ কেউ উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ঢাকা দিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকলেও ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে বেশ টানাপড়েন চলছে। ভারতের সঙ্গে চিকিৎসা এবং ভিসা জটিলতায়ও তিস্তা ইস্যুতে চীন এগিয়ে এসেছে। ফলে এ প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের চীন সফর দেশের জনমানুষের চাহিদার আলোকেও গুরুত্বপূর্ণ।

চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন: চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে বৈঠকে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে বলে জানান মো. জসীম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া স্বাস্থ্য, রোহিঙ্গা, জিডিআই, অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’

সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যে বৈঠকটি হবে, সেটি শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের পছন্দ অনুযায়ী কথা বলবেন। তবে আমাদের দিক থেকে এবং চীনের দিক থেকে পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ আছে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চীন আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু এবং আমরা সেই বন্ধুত্বকে ধারণ করি। চীনের দিক থেকেও একই ধরনের মনোভাব আছে এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব সংহত করার বার্তা আমরা দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘এ সফর থেকে আমাদের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী। এ ছাড়া মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে। আমরা নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করছি এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।

সচিব বলেন, এবারের সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এ ছাড়া কিছু ঘোষণা আসতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে রয়েছে পানি সম্পর্ক উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াবিষয়ক সহায়তা এবং গণমাধ্যমবিষয়ক সহযোগিতা।’ যেসব বিষযে ঘোষণা আসতে পারে সেগুলো হচ্ছেÑ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ক।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশা জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ সংকট দীর্ঘদিনের। এর মধ্যে সাত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্যার যেন সমাধান হয়। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় চীনও আমাদের সহায়তা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বৈঠকে যেটি করছি যে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে উদ্ভূত পরিস্থিতিÑ সেটি নিয়ে চীন কী ভাবছে তা আমরা দেখতে পারি। আমাদের চিন্তা তাদের জানাতে পারি।’

মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা নিয়ে কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছে। চীনে বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম ব্যাচ গিয়েছে। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, তারা চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্ট। এ ছাড়া বাংলাদেশি রোগীদের জন্য কুনমিংয়ে চারটি হাসপাতাল চিহ্নিত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা, সামনের সময়ে এ সহযোগিতা আরও বাড়বে এবং চীন বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করবে, যেটি বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে সুবর্ণজয়ন্তী, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয় হবে। এ বিষয়টি জোর দেওয়ার জন্য আমরা শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলব।’

‘আমাদের দিক থেকে সাধারণভাবে চীনের সঙ্গে যে সামরিক সহযোগিতা আছে, সেগুলোর সাধারণ একটি আলোচনা হবে’ বলে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকালে সফরসঙ্গী থাকবেন ৫৭ জন। প্রধান উপদেষ্টার এই চীন সফর আমাদের বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘চীনের গ্রেট হলে প্রধান উপদেষ্টা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিংপিংয়ের নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কৌশলগত বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ইস্যু, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষি, অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহায়তা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানসহ দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা হবে।’

বৈঠক শেষে বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিয়ে চীনা বিনিয়োগকারীদের অবহিতকরণ এবং বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অংশ নেবেন। সচিব বলেন, চীন থেকে ফিরে আসার পর আগামী ৩ এপ্রিল বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি থাইল্যান্ড যাবেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত রবিবার গণমাধ্যমকে জানান, প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফরে দেশটির সঙ্গে কোনো চুক্তি সই হচ্ছে না। তবে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এ সরকারের সময়ে হওয়া সমঝোতা কিংবা প্রাথমিক উদ্যোগকে পরবর্তী সরকারগুলো এগিয়ে নেওয়ার পথ তৈরি হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হয় চীনে, গত জানুয়ারিতে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চীন। এ বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের মতে, ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে অধ্যাপক ইউনূসের সফর হবে একটি মাইলফলক।

চীনে দায়িত্বপালনকারী সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ এ সফর সম্পর্কে বলেন, ‘শুরুটা চীন দিয়ে হয়েছে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে হবে। যেহেতু এটা দিয়ে শুরু হয়েছে, এর একটা বাড়তি গুরুত্ব দিতেই হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কোনো সহযোগিতার বিষয়ে এগোলে এ কথাটা মাথায় রেখেই এগোতে হবে অন্যপক্ষকে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত