বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

এক সপ্তাহ না যেতেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করলেন প্রধান শিক্ষক

আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:১৭ পিএম

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলির বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ উঠছে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিককের সাথে অসদাচরণ ও হুমকি দেওয়ার পর ইউএনওর কাছে মুচলেকা দেন তিনি। কিন্তু সপ্তার পার না হতেই ফের নতুন বিতর্কে জড়িয়েছেন এই শিক্ষিকা।

জানা গেছে, গত ২৬ মার্চ সকালে ফাতেমা আক্তার মিলির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার প্রতিনিধি শেখ মামুন উর রশিদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন এবং লাঞ্ছিত করার হুমকি দেন তিনি। তার এমন আচরণের ভিডিও ও সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে জেলা জুড়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয় গণমাধ্যম কর্মী, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংষ্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সেই ভিডিও শেয়ার করে ওই প্রধান শিক্ষকর শাস্তির দাবি তোলেন নেটিজেনরা।

এ ঘটনায় পরদিন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি অঙ্গীকারনামা দেন অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক।

অঙ্গীকারনামায় তিনি বলেন, 'আমি আর কোনদিন সাংবাদিক ও জনসাধারণের সাথে অশালীন আচরণ কিংবা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করবো না। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে, তাতে কোন আপত্তি থাকবে না।'

তবে এই ঘটনার এক সপ্তাহ না যেতেই বিদ্যালয়ের দুইজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর কাছে প্রবেশপত্র দেওয়ার শর্তে ছয় হাজার টাকা দাবি করেন প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই সহকারী শিক্ষক মঈনুল ইসলাম প্রতিবাদ জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ফাতেমা আক্তার তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন। এ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাসের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষক ও কর্মমচারী।

এদিকে ওই প্রধান শিক্ষকর অশোভন আচরণ, শিক্ষক-কর্মচারী লাঞ্ছিতসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির নিয়ে বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।

ইউএনওকে দেওয়া লিখিত অভিযোগে প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ও বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন শিক্ষকরা। এতে বলা হয়, প্রয়াত সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের আত্মীয় এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতির বোন। এই রাজনৈতিক পরিচয়ের জোরেই ২০১৫ সালে সাতজন সিনিয়র শিক্ষককে উপেক্ষা করে তিনি সহকারী শিক্ষক থেকে সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান। এরপর থেকেই তিনি বিদ্যালয়ে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম করে নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি একাধিকবার বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে নিজের স্বামীর বড় ভাইকে সভাপতি হিসেবে বসিয়ে পকেট কমিটি গঠন করে নানা অনিয়ম করেছেন। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১১ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন করেন। বিদ্যালয়ের মাসিক আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি না করে একাই পকেটস্থ করেন। এমনকি শিক্ষকদের প্রাপ্য থাকা সত্ত্বেও সরকার নির্ধারিত টিউশন ফি’র অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে তা নিজেই আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, তিনজন শিক্ষক উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একক সিদ্ধান্তে প্রধান শিক্ষক তাদের বঞ্চিত করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় প্রয়োজনীয় নথিতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান। শিক্ষকদের ইএফটি সংশোধনে সহায়তা না করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি চাকরিতে থাকা অবস্থায় নৈশপ্রহরী আব্দুর রহমানের দুই বছরের বেতন বন্ধ করে দেন এবং অবসরের পর তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাও আটকে রেখেছেন এই প্রধান শিক্ষক। 

নৈশপ্রহরী আব্দুর রহমানের ছেলে নুরুজ্জামান জানান, আমার বাবা বেঁচে থাকতে দুই বছর বেতন-ভাতা বন্ধ করে রেখেছিলেন। সেই বেতনের টাকা এখনো পাইনি। বাবা ২০২১ সালে মারা গেলেও বকেয়া ভাতাসহ পেনশনের টাকা আজও উত্তোলন করতে পারিনি। প্রধান শিক্ষককে দুই লাখ টাকা না দিলে তিনি অবসরকালীন ভাতার কাগজে স্বাক্ষর করবেন না। দীর্ঘদিন ধরে তাকে অনুরোধ করেও কোন সহযোগিতা পাইনি।

সহকারী শিক্ষক মঈনুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি এসএসসির প্রবেশপত্র নিয়ে দুইজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা দাবি করা হয়। আমি এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আমার ওপর চড়াও হন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং জুতাপেটা করার হুমকি দেন। এর আগেও বিদ্যালয়ের পিয়ন আব্দুর রাজ্জাককে তিনি প্রকাশ্যে মারধর করেন। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি।

দেশ রূপান্তরের সাংবাদিক শেখ মামুন উর রশিদ বলেন, স্বাধীনতা দিবসে প্রধান শিক্ষকের অশোভন আচরণে আমরা মর্মাহত হয়েছি। তিনি ইউএনও’র কাছে ভবিষ্যতে এমন আচরণ না করার অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু ফের একই পথে হাঁটলেন। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন আচরণ কাম্য নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও সম্মান রক্ষায় প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষক ও সাংবাদিকের আচরণ আমি দেখেছি, তাই মন্তব্য করতে চাই না। তবে শিক্ষকরা যে ইউএনও স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন তা শুনেছি। আমার কাছে তদন্তের জন্য এখনো কোনো কাগজ আসেনি। পেলে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করবো।’

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সাহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করতে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি। তিনি প্রতিবেদন দাখিল করলে ম্যানেজিং কমিটির সভা ডেকে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকের সঙ্গে অশোভন আচরণের ঘটনায় তাকে ডেকে এনে মুচলেকা নেওয়া হয়েছিল। তিনি এমন আচরণ ভবিষ্যতে করবেন না বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। নতুন ঘটনায় সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়েছে কিনা, তদন্তে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিক আশরাফ বলেন, ‘শিক্ষকরা সমাজের একধরনের দর্পণ। একজন শিক্ষক কেবল শ্রেণি কক্ষের শিক্ষক নন, তিনি সমাজেরও শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা শুধু তার পাঠদান থেকেই নয়, তার আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা সব কিছু থেকেই শেখে। শিক্ষার্থীদের কথাবার্তা, চলাফেরা, এমনকি তারা অন্যদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করে, সেটার পেছনেও শিক্ষকের ছায়া পড়ে। তাই শিক্ষককে সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। শিক্ষকতা একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা। সারা পৃথিবীতে এই পেশার প্রতি সম্মান রয়েছে। সেই সম্মান ও মর্যাদা ধরে রাখার দায়িত্ব শিক্ষকদেরই নিতে হবে। যারা সেটা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন, তারা শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ বলে বিবেচিত হবেন।’

সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষকের অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি ওই ঘটনার ভিডিও দেখেছি। একজন শিক্ষক হিসেবে এমন আচরণ অত্যন্ত বিব্রতকর ও দুঃখজনক। একজন শিক্ষকের উচিত সংযত থাকা, বিশেষ করে জনসম্মুখে। তিনি যেহেতু শুধু একজন ব্যক্তি নন, অন্য শিক্ষকদেরও প্রতিনিধিত্ব করেন, তাই তার আচরণ সমগ্র শিক্ষক সমাজকেই প্রভাবিত করে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত