সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে সবচেয়ে ফজিলতময় হলো জুমার দিন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সূর্যোদয় হওয়ার দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমার দিন। জুমার দিন হজরত আদম (আ.)- কে তৈরি করা হয়েছে। এই দিনেই তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছে, এই দিনেই তাকে বেহেশত থেকে বের করে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। আর কেয়ামত জুমার দিনেই সংগঠিত হবে।’ (সহিহ মুসলিম ৮৫৪)
হাদিসে জুমার দিনকে মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জুমার নামাজ কেন্দ্র করে একত্র হয় সব মুসলমান। এই দিনে সবাই সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি মেখে মসজিদে আসে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এককাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। একে অন্যের খোঁজ-খবর নেয় এবং মতবিনিময় করে। এতে পরস্পরে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। অনেক আত্মীয়স্বজন ও প্রিয় মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়। ভেতর ভেতর এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। সবার মুখে লেগে থাকে মুচকি হাসি। এভাবে জুমার দিনে মুসলমানদের আনন্দের অনেক উপলক্ষ তৈরি হয়। হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এ দিনকে মুসলমানদের ঈদের দিনরূপে নির্ধারণ করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি জুমার নামাজ আদায় করতে আসবে সে যেন গোসল করে এবং সুগন্ধি থাকলে তা শরীরে লাগায়। আর মিসওয়াক করাও তোমাদের কর্তব্য।’ (ইবনে মাজাহ ১০৯৮)
জুমার দিনে যেমন আনন্দের অনেক উপলক্ষ তৈরি হয় তেমনি এই দিনে জুমার নামাজে রয়েছে অসংখ্য ফজিলত ও রহমত। এই দিনে মহান আল্লাহ বান্দার অসংখ্য গুনাহ ক্ষমা করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এক জুমা পরবর্তী জুমা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহের কাফফারা স্বরূপ। যদি না কবিরা গুনাহ করা হয়।’ (ইবনে মাজাহ ১০৮৬)। একদিকে আনন্দ এবং অন্যদিকে আল্লাহর ব্যাপক রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তি, এ দুইয়ে মিলেই শুক্রবার বান্দার জন্য সাপ্তাহিক ঈদ। আল্লাহতায়ালা জুমার নামাজে যে ফজিলত ও রহমত দান করেছেন, তা পুরোপুরিভাবে অর্জন করার জন্য আবশ্যক হলো জুমার আজানের সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত মসজিদে চলে আসা। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! জুমার দিন যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি করো।’ (সুরা জুমা ০৯) জুমার নামাজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। হজরত আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে পূর্বে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার আগে আসে, সে ওই ব্যক্তির ন্যায়, যে ব্যক্তি একটি মোটাতাজা উট কোরবানি করে। অতঃপর যে ব্যক্তি আসে সে ওই ব্যক্তির ন্যায় যে একটি গাভি কোরবানি করে। এরপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগি দানকারীর ন্যায়। তারপর আগমনকারী ব্যক্তি একটি ডিম দানকারীর ন্যায়। অতঃপর ইমাম যখন খুতবা দেওয়ার জন্য বের হন তখন ফেরেশতারা তাদের খাতা বন্ধ করে দিয়ে মনোযোগ সহকারে খুতবা শ্রবণ করতে থাকে।’ (সহিহ বুখারি ৯২৯)
আমাদের সমাজে কিছু মুসলমান আছে, যারা জুমার নামাজেও অংশগ্রহণ করে না। সাপ্তাহিক ঈদের আনন্দ এবং আল্লাহর অপার রহমত থেকে তারা বঞ্চিত হয়। তাদের জন্য সঞ্চিত আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা ভ্রষ্টতার এতটাই অতল গহ্বরে প্রবেশ করে যে, উপলব্ধি করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে। তাদের বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো কারণ ছাড়া পরপর তিন জুমা ছেড়ে দেয়, আল্লাহতায়ালা তার অন্তরে মোহর মেরে দেন।’ (বায়হাকি ৫৭৮৫) জুমার দিনে অত্যন্ত ফজিলতময় কিছু আমল রয়েছে। সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
এক. জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যখন দোয়া করলে কবুল করা হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন কোনো মুসলিম বান্দা মহান আল্লাহর কাছে কল্যাণকর কিছু কামনা করলে অবশ্যই তাকে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি) তবে সেই মুহূর্তটি ঠিক কোন সময় এ নিয়ে অনেকগুলো মতামত পাওয়া গেলেও ইবনে হাজমসহ অধিকাংশের আলেমের মতে দুটি মুহূর্তের একটি হলো, দুই খুতবার মধ্যবর্তী সময়, আরেকটি সূর্যাস্তের আগ মুহূর্তে।
দুই. সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তার ইমানের জ্যোতি এক জুমা থেকে আরেক জুমা পর্যন্ত চলতে থাকবে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ) সুরা কাহাফ বৃহস্পতিবার সূর্যাস্তের পর থেকে শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত পড়া যাবে। একসঙ্গে পড়া জরুরি নয়। আর না পারলে অন্তত দশ আয়াত তেলাওয়াত করার কথা বলা হয়েছে। সুরা কাহাফ তেলাওয়াতের দ্বারা দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
তিন. হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা। হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জুমার দিন আমার ওপর বেশি বেশি করে দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ) দরুদ শরিফ পাঠ সম্পর্কে অন্যত্র হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করবেন।’ (জামে তিরমিজি)
তাই আসুন, আল্লাহতায়ালা আমাদের উপহারস্বরূপ ফজিলতময় সাপ্তাহিক যে ঈদ দান করেছেন তা থেকে আনন্দিত ও উপকৃত হই। যাতে আমাদের জন্য রয়েছে উভয় জগতের সফলতা।