আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নানা কথা বলছে। সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কার ও শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার নিশ্চিত করার পর নির্বাচনের কথা বলছেন দলটির নেতারা। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে দলটির নেতারা কোনো কথা বলেননি। তবে গত বুধবার ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে দলটির আমির আগামী রমজানের আগেই নির্বাচনের দাবি জানান। যদিও গতকাল শুক্রবার কুমিল্লায় দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রয়োজনীয় সংস্কার, মানবতাবিরোধীদের বিচার করে নির্বাচন চেয়েছেন।
নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের অবস্থানের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী কবে নির্বাচন চায় তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। তারা একেক সময়ে একেক কথা বলে। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাই।’
জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর তারা নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের কথা বলেছে। তাদের ওপর আমাদের ভরসা নেই। তারা কখন কী বলে, না বলে তার ঠিক নেই। তারা সবসময় নিজেদের সুবিধা বুঝে কথা বলে। তারা তাদের কথা বলুক। আমরা আমাদের কথা বলে যাব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যেতে চাইলেও তাদের সে সক্ষমতা নেই। তারা বিগত নির্বাচনগুলোতে বিএনপির কাছ থেকে আসন চেয়ে নিয়েছে। আসলে তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসতে চায়। সেজন্য কিছু আসনে বিএনপির কাছ থেকে ছাড় চায়। লন্ডনে দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। তবে দলের দুই শীর্ষ নেতা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। ভেবে দেখার কথা জানিয়েছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটিও (এনসিপি) বিএনপির কাছে আসন চেয়েছিল। কিন্তু যে পরিমাণ আসন চেয়েছিল, তার বিপরীতে নেতাদের তালিকা দিতে পারেনি।’
গতকাল কুমিল্লার লাকসাম সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আপনার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করুন। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে মানবতাবিরোধীদের বিচার করে নির্বাচন দিন।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে মিট দ্য প্রেসের আয়োজন করেন জামায়াত আমির। সেখানে সাংবাদিকদের কাছে তিনি নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কার সাধন না করে যে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচন গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনা করতে পারবে না। আমরা নির্বাচনের দাবি করতে পারি, দিনক্ষণ ঠিক করে দিতে পারি না।’ নির্বাচনের আগে তিনি তিনটি শর্ত দিয়েছেন এক. সংস্কার; দুই. বিচার ও তিন. পারস্পরিক রাজনৈতিক সহাবস্থান।
গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে মার্কিন ডেপুটি হেড অব মিশনের বাসভবনে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে জামায়াতের আমির নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বলেন, ‘আমরা চাই আগামী নির্বাচন পবিত্র রমজানের আগেই অনুষ্ঠিত হোক। কারণ জুনের দিকে দেশে বর্ষা, ঝড় ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে, যা নির্বাচনী কার্যক্রমকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তাই রমজানের আগেই নির্বাচন শেষ হওয়া উচিত।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। আমরা প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা দিয়েছেন তার মধ্যেই নির্বাচন চাই। আমাদের আমির রমজানের আগে নির্বাচন চান বলে যে বক্তব্য গত বুধবার দিয়েছেন সে বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার আবার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, জুনের দিকে বৃষ্টির সিজন শুরু হতে পারে। তখন নির্বাচন করা অসম্ভব হতে পারে। তাই রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে। তবে তার আগে সংস্কার ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রম যতটা এগিয়েছে তাতে রমজানের আগে নির্বাচন করা সম্ভব। জুনের মধ্যে হলেও আমাদের আপত্তি থাকবে না।’
হঠাৎ করে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের কাছাকাছি আসার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, এটা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের সাক্ষাতের ফল। গত রবিবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের যে অবস্থান ছিল, তা বিএনপির সঙ্গে মেলে না। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান আগামী বছরের রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি এক ধরনের পরিবর্তন। এ পরিবর্তন হয়তো লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের ফল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ নিজ চিন্তাভাবনা অনুযায়ী কথা বলে। হয়তো জামায়াতে ইসলামী মনে করছে নির্বাচন দেরিতে হলে তারা গুছিয়ে নিতে পারবে। তাড়াতাড়ি করলে বিএনপি লাভবান হবে। বিএনপি চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে। আবার জামায়াতে ইসলামী রমজানের আগে নির্বাচনের কথা বলছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে তারা নির্বাচন চায়। আমার ধারণা বড় দুটি দল যেহেতু আলাদা আলাদা মাসের কথা বলছে, সেহেতু নির্বাচন জানুয়ারিতে হতে পারে।’