জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে আর কখনো যেন ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে না আসে, সেজন্য সব পথ বন্ধ করেই এনসিপি সামনে এগোবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ব্যক্তি বদল নয়, বরং রাষ্ট্রের গুণগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলা।’
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
বৈঠকের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘একটি নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমাদের কাজ, সবাই মিলে সেই বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ফ্যাসিবাদী শাসন যেন আর কখনো না ফিরে আসে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় কিছু বিষয়ে একমত এবং কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও আলোচনা চলবে এবং প্রয়োজনে তা অব্যাহত রাখা হবে।’
রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন চায় এনসিপি
বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলেছিলাম, এটি শুধু ব্যক্তি বদল বা দলবদলের জন্য নয়। বরং রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক ও গুণগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার রক্ষা করা— এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’
তিনি বলেন, এনসিপি যখন ‘সংস্কার’ বলে, তারা শুধু কসমেটিক পরিবর্তন নয়, বরং আমূল পরিবর্তনের কথা বলে। তার ভাষায়, ‘যে সংস্কারে রাষ্ট্রের মৌল কাঠামো বদলে যাবে, সেটিই আমাদের সংস্কারের মূলে রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে জোর
নাহিদ ইসলাম জানান, এনসপি সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা, বিচার ও নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংস্কারের কথা বলছে। ‘আমরা এমন একটি কাঠামো চাই, যেখানে কারও হাতে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ থাকবে না আর ফ্যাসিবাদের জন্ম নেওয়ার পথগুলো থাকবে বন্ধ।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনার ওপর মন্তব্য করে তিনি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এনসিপি একমত আর যেসব ক্ষেত্রে মতপার্থক্য রয়েছে, সেখানে সংক্ষিপ্ত সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়
বৈঠকের বিরতিতে (বেলা সোয়া ১টায়) এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনের আগে জনগণের চোখে বিচার ও কাঠামোগত সংস্কার দৃশ্যমান হতে হবে।’ তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান দিয়ে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ‘প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়ে ফ্যাসিবাদকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। আমরা ক্ষমতার ভারসাম্য, জাতীয় ঐকমত্য এবং গণপরিষদের কথা বলছি।’
একটি নির্বাচন, দ্বৈত দায়িত্ব
দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দুটি নির্বাচন চাই না। একটি নির্বাচনেই আইনসভা এবং গণপরিষদের ভূমিকা চাচ্ছি, যার প্রথম কাজ হবে সংবিধান পুনর্লিখন করা।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের মৌলিক সংস্কার একমাত্র গণপরিষদের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই আইনসভা নির্বাচনের মাধ্যমেই গণপরিষদের স্ট্যাটাস দেওয়ার দাবি করছি।’
বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে কিছু সুপারিশে মতানৈক্য থাকলেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন নেতারা। হাসনাত বলেন, ‘ঐক্য দলীয় নয়, এটি জাতীয় স্বার্থে হওয়া উচিত। আলোচনা অব্যাহত থাকবে।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, আমরা এখনো এই নীতিতেই অটল আছি।’
ভিন্নমতের জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা হবে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘এখন এক নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমাদের কাজ সবাই মিলে যেন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারি, যেখানে ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরত না আসে।’
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া সুপারিশগুলোর মধ্যে কিছুতে এনসিপির একমত, আবার কিছুতে ভিন্নমত রয়েছে। ‘আমরা একমতের জায়গাগুলো চিহ্নিত করেছি এবং সেগুলো নিয়ে এগোব। যেসব জায়গায় আংশিক একমত বা ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আজ আলোচনা হবে এবং প্রয়োজনে এই আলোচনা চলবে,’ বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা (এনসিপি) প্রাণবাজি রেখে লড়াই করে ফ্যাসিবাদী শাসককে পলায়ন করতে বাধ্য করেছেন। আপনারা সুস্পষ্টভাবে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছেন, যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।’
বাংলাদেশে অতীতে গণতন্ত্র বারবার পর্যুদস্ত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা দেখেছি, কীভাবে এক ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্র কেন্দ্রীভূত করে শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। এখন সময় এসেছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী রূপ দেওয়ার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সব ধরনের নিপীড়ন রোধ করার।’
বৈঠকে কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, এনসিপির আট সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, জাবেদ রাসিন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারোয়ার নিভা।
এনসিপির তৃতীয় সাধারণ সভা
আগামী দিনের কর্মসূচি ও অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক নীতিমালা নির্ধারণ, সংস্কারের প্রস্তাব প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তৃতীয় সাধারণ সভায়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনপরিসরে এনসিপির বেশ কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাংগঠনিক ‘শৃঙ্খলা ও তদন্ত’ কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। জেলা-উপজেলায় কমিটির আহ্বায়ক হতে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে রাজধানীর বাংলা মোটরে রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা হয়। এনসিপির তৃতীয় সাধারণ সভায় দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনসিপি জানায়, দলের সাধারণ সভায় এনসিপির অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক নীতিমালা নির্ধারণ, সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাব প্রণয়ন, গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের বিচার ও গণপরিষদ নির্বাচন দাবিতে কর্মসূচি নির্ধারণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর নীতি গ্রহণে সরকারকে দাবি জানানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি সহিংসতা ও ভারতে ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনমনে স্বস্তি আনতে সরকারকে জোর দাবি জানানোর বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
সভায় দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রস্তাব করেন মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ।
নীতিমালায় সাংগঠনিক কাজের স্বার্থে ৬৪টি জেলাকে ১৯টি জোনে ভাগ করা হয়। এ ছাড়া কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলাপর্যায়ে সর্বনিম্ন ৩১ থেকে সর্বোচ্চ ৫১ সদস্যের এবং উপজেলা পর্যায়ে সর্বনিম্ন ২১ থেকে সর্বোচ্চ ৪১ সদস্যের কমিটি গঠিত হবে। উভয় কমিটির আহ্বায়ক পদে বয়স সর্বনিম্ন ৪০ বছর হতে হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।