চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। তবে তিনি প্রকাশ্যে না এলেও দেশ অস্থিতিশীল করতে বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে রাজপথে নামার ছকও তৈরি হয়েছে। আগামী মে ও জুনকে টার্গেট করে রাজপথ দখলের পরিকল্পনা করেছেন আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নির্দেশনা অনুযায়ী দেশব্যাপী ঝটিকা মিছিল বের করছেন তারা।
দেশ অস্থিতিশীল করার ঝটিকা মিছিল রুখতে তৎপর রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, গত তিন দিনে সারা দেশ থেকে ৪ হাজার ৭৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যার তিন ভাগের দুই ভাগই আওয়ামী লীগের সদস্য। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি মাঠে থাকছেন ছাত্ররাও। তবে নিষিদ্ধ সংগঠনের এমন ঝটিকা মিছিল নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মিছিল কন্ট্রোল করতে না পারলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
গতকাল সোমবার বিকেলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত শনিবার রাতে চার ঘণ্টাব্যাপী ‘ধানম-ি বত্রিশ’ টেলিগ্রাম গ্রুপে গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও থানার নেতাকর্মীদের সঙ্গে জুম মিটিং করেন। তিনি দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপাতত ফান্ডের সমস্যা’। বিদেশ থেকে কেউ টাকা পাঠাতে পারছে না। তাই প্রতি জেলায় ঝটিকা মিছিল দিয়ে শুরু করতে হবে। এই মিছিলে থাকবে স্থানীয় ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীরা। এ ছাড়া নির্দেশ রয়েছে, রিকশা, অটোচালক এবং বাসের হেলপারের ছদ্মবেশে ঝটিকা মিছিলে অংশ নিতে। প্রয়োজনে আত্মরক্ষার্থে ইলেকট্রিক শক ডিভাইস ও ক্ষুদ্র জিনিসপত্র রাখতে হবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, নিম্নপর্যায়ের নেতাকর্মীরা যারা বিদেশে আছেন, তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হবে। যদি এক হাজার নেতাকর্মী আসেন, প্রয়োজনে ২০০ গ্রেপ্তার হলেও রিজার্ভে থাকবেন ৮০০। ৬৩ জেলায় অন্তত ১৫ লাখ লোককে জমায়েতের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। মে ও জুন মাসের মধ্যেই তারা বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। যেখানে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের আশঙ্কাও রয়েছে।
ইতিমধ্যে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের ঝটিকা মিছিল বের করার ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশত ঝটিকা মিছিল হয়েছে। সারা দেশে জেলা, থানা ও ওয়ার্ডপর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল বের করছেন। এসব মিছিলে ফটোসেশন করা হচ্ছে।
অনেক নেতাকর্মী সোশ্যাল মিডিয়ায় ছদ্মনামের আইডিতে সেগুলো পোস্ট করছেন। মিছিলের ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের বাইরে পলাতক থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে। মিছিলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বেড়ে গেছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ১ মার্চ পর্যন্ত ২২ দিনে সারা দেশে অপারেশন ডেভিল হান্ট অভিযানে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সাড়ে ১২ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার অভিযান একটু থেমে ছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিলকে কেন্দ্র করে আবারও বেড়েছে এই গ্রেপ্তারের সংখ্যা।
আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল কন্ট্রোলে গাফিলতি হলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে মিছিল না হতে পারে, সে ব্যাপারে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা কন্ট্রোল না করতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন মিছিল বের করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, মিছিলকারীদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলেও পরে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অনেককে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। জনবিচ্ছিন্ন ও বেআইনি সংগঠনের অপতৎপরতা রোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন মিছিল করলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে উসকানিমূলক বার্তা দিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় ঝটিকা মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঝটিকা মিছিল দিয়ে শুরু করে লগি-বইঠা নিয়ে রাজধানীতে ব্লকেডের পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিলেন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তবে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের জোটবদ্ধতার কারণে ভেস্তে গেছে তাদের সেই পরিকল্পনা। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাজধানীসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে গ্রুপ চ্যাট ও অডিও বার্তার মাধ্যমে এসব আলোচনা হয়েছে বলে একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন। এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঝটিকা মিছিল নিয়ে যারা রাজপথে নামার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।
গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাসের একটি অডিও রেকর্ড বার্তা ভাইরাল হয়। সেখানে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে এই নেতা বলেন, এখনই রাজপথে না নামতে। আপাতত সংগঠিত হয়ে এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দেশনা মেনে তিনি মাঠে নামার ঘোষণা দেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও তাদের সমভাবাপন্ন বিভিন্ন সংগঠনের ঝটিকা মিছিলের বিষয়ে কঠোর বার্তায় বলা হয়েছে, ‘মিছিলকারীদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলেও পরে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অনেককে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জনবিচ্ছিন্ন ও বেআইনি এসব সংগঠনের অপতৎপরতা রোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে।’
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. তালেবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সংগঠন, তাই তারা মিছিল করলেই গ্রেপ্তার করা হবে।’ আওয়ামী লীগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অ্যাক্ট অনুযায়ী কেউ সমাবেশ করতে চাইলে পূর্বানুমতি নিতে হবে। অনুমতি না নিলে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে। সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা দিলে বা যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মিছিল করলে ডিএমপি অ্যাক্টে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্যের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ হলো পানিভর্তি পুকুরের মধ্যে ফোটা শাপলার মতো। এই শাপলার জন্য কেউ বীজ বুনে না, এরা একা একাই জন্মায়, ফুলও ফোটে। তেমনি আওয়ামী লীগ এমনিতেই জন্ম নেয় এবং জাতিকে নিয়ে ফুল ফোটায়।