মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা

প্রথম পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে

আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৪ এএম

জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায়। আন্দোলনের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে।

গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের করফারেন্স কক্ষে এ বিষয়ে বিস্তারিত সাংবাদিকদের অবহিত করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, গত রবিবার প্রতিবেদনটি তাদের কাছে আসে। এখন এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে দাখিল করা হবে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন হলেই মামলাটি বিচারের পর্যায়ে আসবে বলে জানান অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।

ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত প্রথম প্রতিবেদনে আসামি করা হয়েছে আটজনকে। তারা হলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, পুলিশের রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, সাবেক এসি মো. ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন ও কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম।

প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়, প্রতিবেদনটি ৯০ পৃষ্ঠার। চানখাঁরপুলে হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ৬ মাস ১৩ দিন (১৯৫ দিন) সময় নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ঘটনার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। এতে ৭৯ জনের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার সময়ের ১৯টি ভিডিও ফুটেজ, ১১টি পত্রিকার প্রতিবেদন, ২টি অডিও রেকর্ড, বই ও রিপোর্ট ১১টি এবং ৬টি ডেথ সার্টিফিকেট রয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। গণআন্দোলন দমাতে ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন সরকারের বিরুদ্ধে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার মতে, অন্তত ১ হাজার ৪০০ লোককে হত্যা করা হয় গণঅভ্যুত্থানের সময়। আহত হয় ২০ হাজারের বেশি মানুষ। গত বছর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সে সরকার এসব গণহত্যা ও নির্যাতনের বিচারের উদ্যোগ নেয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন বিচারকের বিচারিক প্যানেল। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাও পুনর্গঠন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিচারের উদ্যোগ শুরু হয়।

তদন্ত সংস্থার প্রাথমিক তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১৭ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে প্রাথমিক বিচারকাজ শুরু হয়। একই দিন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের কয়েকজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ হয়। প্রসিকিউশন ইতিমধ্যে জানিয়েছে, পুনর্গঠনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় ৩৩৯টি অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে ২২টি মামলা হয়েছে। আর এসব মামলায় প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত ১৪১ জন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫৪ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। ৮৭ জন এখনো পলাতক।

প্রথম প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে : প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরের চানখাঁরপুলে আসামিগণ কর্তৃক নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে চানখাঁরপুলে ছয়জন নিহতের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মোহাম্মদ ইয়াকুব, শহীদ মো. রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো. ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকালে পলাতক আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্য আসামিদের সরাসরি তত্ত্বাবধান/সরাসরি অংশগ্রহণ, অধীনস্থদের নির্দেশ প্রদান, সহযোগিতা, সুযোগ তৈরি, সহায়তা এবং তিনি (হাবিবুর রহমান) তার অধীনস্থদের মাধ্যমে নির্যাতন, হত্যাকা- সংঘটন, উক্তরূপ অপরাধ সংগঠন হতে বিরত না রাখা কিংবা হত্যাকান্ড সংগঠনকারীদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা না নেওয়াসহ অন্যান্য উপায়ে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস), ১৯৭৩ এর ৩ (২) (এ) (এফ) (জি) (এইচ) এবং ৪ (২) এবং ৪ (৩) ধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, যা একই আইনের ২০ (২), ২০ এ ধারায় শাস্তিযোগ অপরাধ।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, এ তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রসিকিউশন এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আদালতে দাখিল করবে। কয়েক দিনের মধ্যে এটা আমরা আদালতে দাখিল করব। দাখিলের পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের যে যাত্রা সেটা শুরু হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘পুলিশের যারা সিনিয়র অফিসার তাদের বিরুদ্ধে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগে এবং যারা সরাসরি গুলি করেছেন বিভিন্ন ভিডিওর মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে। যে কারণে এই আটজনের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।’ অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চানখাঁরপুলের এই ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অপরাধের সম্পৃক্ততার তথ্য এসেছে। কিন্তু যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে তদন্ত চলমান আছে এবং সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে একটাই অভিযোগ দেওয়া হবে, এ কারণে এই অভিযোগে তাদের বিচারের জন্য উপস্থিত করা হয়নি।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত