শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা, মর্যাদাপূর্ণ ন্যূনতম মজুরি ও কমিশন ঘোষণা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ট্রেড ইউনিয়নের শর্ত শিথিল, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করাসহ শ্রমিকদের স্বার্থে ২৫টি মূল সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন।
গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।
কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশেষ সুপারিশ করেছে কমিশন। সেগুলো হলো শ্রম আইনে মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী শব্দ ব্যবহার এবং কর্মক্ষেত্রে তুই/তুমি সম্বোধন বন্ধ করা। সেই সঙ্গে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার কথা বলা হয়েছে, যে সুপারিশ অন্যান্য কমিশনও করেছে। এ ছাড়া মজুরি দেরিতে হলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরি : সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছে। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা সাত কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই। শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিটি এই শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে।
কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের শ্রমিকদের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কমিশন। লক্ষ্য হলো, কোনো শ্রমিক যেন তার চেয়ে কম মজুরি না পান, তা নিশ্চিত করা। সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করারও কথাও বলেছে কমিশন। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের দর-কষাকষি করার প্রক্রিয়া যেন আরও সহজ হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি দূর করতে ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে কাজের স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর-শোভন কর্ম পরিবেশ, অস্থায়ী ও এজেন্সিনির্ভর নিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশে নিজের ও পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন উপযোগী ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ), উন্নয়নে ন্যায্য অংশীদারত্ব ও হিস্যাপ্রাপ্তির অধিকার, প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ কাজ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, দুর্ঘটনায় যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং নিজের ও পরিবারের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার, প্রত্যেকেরই অবসর, কর্ম-অক্ষমতা, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন সময় বা যেকোনো প্রতিকূল অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাপ্রাপ্তি এবং কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্তি, প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সংগঠিত হওয়া, সমষ্টিগতভাবে প্রতিনিধিত্ব করার, অধিকার লঙ্ঘনে অভিযোগ জানানো, প্রতিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বিষয়ে পৃথক এক ব্রিফিংয়ে কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ জানান, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের লক্ষ্যে গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
কমিশনের প্রধান বলেন, ‘প্রতিবেদনে জাতীয় শ্রম কমিশন গঠনের কথা বলেছি। প্রত্যেকের কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। প্রত্যেকের মজুরির মাত্রা থাকবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশের গ্যারান্টি দিতে হবে।’
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, বর্তমান শ্রম আইন অনেকাংশেই বৈষম্যমূলক, যা অনানুষ্ঠানিক খাতসহ বহু শ্রমজীবী মানুষকে সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। এরই প্রেক্ষাপটে একটি সর্বজনীন শ্রম আইন এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনের সুপারিশ করা হয়।
শ্রমিক আন্দোলনে নিহতদের ‘শহীদ’ স্বীকৃতি দেওয়া : প্রতিবেদনে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও শ্রমিক আন্দোলনে নিহত সব শ্রমিককে রাষ্ট্র কর্তৃক শহীদের স্বীকৃতি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রম খাতে দুর্ঘটনা বা অবহেলাজনিত কারণে নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণের সুপারিশ করেছে কমিশন।
একই সঙ্গে রানাপ্লাজা, তাজরীন গার্মেন্ট এবং হাসেম ফুডসহ উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার ও দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু সুপারিশ : কর্মপরিবেশ ভালো করতে প্রতিবেদনে জাতীয় সামাজিক সংলাপ কোরাম রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রত্যেক অভিবাসী শ্রমিক যদি নিবন্ধিত হন, তবে তিনি শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন বলেও জানিয়েছে কমিশন। রানাপ্লাজার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরাপত্তার সেক্টর শক্তিশালী করারও কথা বলা হয় প্রতিবেদনে।
শ্রমিকদের কল্যাণে সর্বজনীন তহবিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রম আদালতসহ আপিল বিভাগের সর্বক্ষেত্রে যেন বাংলা প্রচলন করা হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-পুরুষের সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী ডেটাবেজ তৈরি, শ্রম অসন্তোষ নিরসনের পাশাপাশি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা ও শ্রমিক ফেডারেশনকে জবাবদিহির মধ্যে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া জবাবদিহিমূলক শ্রম প্রশাসনব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
কায়িক, মানসিক ও প্রজনন শ্রমসহ সব খাতের শ্রমিককে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং একই আইনের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করতে সংগঠন, মজুরি দরপত্রে অংশগ্রহণ এবং ধর্মঘটের পূর্ণাঙ্গ অধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধে স্পষ্ট আইন এবং প্রতিকার কাঠামো প্রণয়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
শিশুশ্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে তার বিকল্পে শিক্ষা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং শ্রম আদালত ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রমিকবান্ধব এবং কার্যকরভাবে সংস্কার করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেনশন, চিকিৎসা, দুর্ঘটনা বীমা, অবসরভাতা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করে একটি সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিভিন্ন সংকট ও দুর্যোগে শ্রমিকদের সুরক্ষায় সরকারকে জরুরি ও আপদকালীন তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় তহবিলের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করারও তাগিদ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদকে প্রধান করে গত বছরের ১৭ নভেম্বর ১০ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। তবে কমিশন একাধিকবার সময় বাড়িয়ে নিয়েছে।