শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

নামাজ না পড়ার শাস্তি

আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৫৮ এএম

নামাজ মুসলমানদের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিসে নামাজের গুরুত্ব নিয়ে অসংখ্যবার আলোচনা এসেছে। এমনকি কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে বিষয়ের হিসাব নেওয়া হবে, তা হলো নামাজ। নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ এবং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সংযোগের একমাত্র নিরবচ্ছিন্ন মাধ্যম। একে বলা যায়, মুমিন জীবনের আত্মিক শক্তির উৎস এবং পাপ-পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার কার্যকর পথ। নামাজ আদায়ের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি তা বর্জনের শাস্তিও ভয়াবহ। অনেকেই কেবল দুনিয়ার ব্যস্ততার অজুহাতে কিংবা অলসতার কারণে নামাজ ছেড়ে দেন, অথচ তারা উপলব্ধি করতে পারেন না, এতে কেবল তাদের দুনিয়া নয়, আখেরাতও ধ্বংস হয়ে যাবে। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যারা নামাজ আদায় করে না, তারা জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। এমনকি হাদিসে নামাজ না পড়া একজন ব্যক্তিকে কাফের বা মুশরিকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বেনামাজির জন্য রয়েছে কঠিন আজাবের ঘোষণা।

বর্তমান যুগে যখন মানুষ নানাবিধ মানসিক ও পারিবারিক টানাপড়েন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আত্মিক দুর্বলতার মধ্যে দিনযাপন করছে, তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জীবনের জন্য হয়ে উঠতে পারে পরিপূর্ণ প্রশান্তির ওষুধ। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ যেমন জোরদার হয়, তেমনি শরীর ও মনের ওপরও এর পড়ে ইতিবাচক প্রভাব। আধুনিক গবেষণাও প্রমাণ করেছে যে নিয়মিত নামাজ আদায় করলে মনের বিষন্নতা কমে, দেহে কর্মশক্তি বাড়ে এবং নিজের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ গড়ে ওঠে।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলিম সমাজে অনেকেই আজ নামাজকে অবহেলার চোখে দেখেন। কেউ সময়ের অভাবে, কেউ বা অলসতা কিংবা অবজ্ঞায় নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরজকে এড়িয়ে যান। অথচ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, নামাজ ত্যাগকারী ব্যক্তি ইসলামের সীমানা থেকে বের হয়ে যায়। এমন ভয়াবহ পরিণতির কথা জেনেও আমরা যদি নামাজে অবহেলা করি, তবে সেটার দায়ভার আমাদেরই বহন করতে হবে।

নামাজ মানুষের বোধশক্তিকে জাগ্রত করে পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রেখে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে। নামাজের মাধ্যমে বান্দার রুহ তাজা হয়। এর মাধ্যমে বান্দা গুনাহমুক্ত হয়। নামাজের প্রতিটি সেজদায় বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা মহান আল্লাহর জন্য একটি সেজদা করে, মহান আল্লাহ এর বিনিময়ে তাকে একটি নেকি দান করেন, তার একটি গুনাহ মাফ করেন এবং তার মর্যাদা এক ধাপ উন্নত করেন। অতএব তোমরা অধিক সংখ্যায় সেজদা করো। (ইবনে মাজাহ)

নামাজ এমন ইবাদত, যা শুধু নিজে আদায় করলেই হয় না; বরং অধীনস্তদেরও আদায়ের নির্দেশ দিতে হয়। নিজে নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ, তেমনি পরিবার-পরিজনকে নামাজের আদেশ দেওয়াও ফরজ। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদের নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন।’ (সুরা তাহা ১৩২) আর হজরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর সব অভিভাবকের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের ৭ বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও এবং ১০ বছর বয়সে তাদের নামাজে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য কঠোর শাসন করো।’ (আবু দাউদ ৪৯৫) নামাজ আদায়ের দায়িত্ব থেকে কেউ রেহাই পায় না। নামাজের সময় হলে সব মুমিন ব্যক্তি নামাজ আদায় করতে বাধ্য।

নামাজ মুসলমান হওয়ার পরিচয় বহন করে। পক্ষান্তরে নামাজ বর্জন কাফেরদের সাদৃশ্য তুলে ধরে। আজান দেওয়ার পর কোনো কাফের নামাজ আদায় করতে যায় না। তাই নামাজের সময় কোনো মুসলমানও যদি নামাজ আদায় না করে কিংবা মসজিদে না যায়, তাহলে কাফেরদের সঙ্গে তার এক ধরনের সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। এ কারণেই হাদিস শরিফে নামাজ বর্জনকে কুফরিতুল্য পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমাদের ও কাফেরদের মধ্যে মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা হলো নামাজ। সুতরাং যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দেয়, সে কুফরি কাজ করে। (জামে তিরমিজি)

নামাজ ত্যাগ করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ ও কঠিন। যারা বিনা ওজরে নামাজ ত্যাগ করবে তাদের জন্য রয়েছে নিদারুণ নরকের যন্ত্রণা। এ ছাড়া নামাজের ব্যাপারে যারা উদাসীন থাকে তাদের ব্যাপারে শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘অতএব দুর্ভোগ সেই সব নামাজ আদায়কারীদের জন্য যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।’ (সুরা মাউন ৪-৬) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘(সেদিন) অপরাধীদের সম্পর্কে পরস্পরে জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের কীসে জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছে? তারা বলবে, আমরা নামাজি ছিলাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির ৪১-৪৩) এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয় যারা নামাজ আদায় করবে না, তারা জাহান্নামে যাবে।

কেয়ামতের দিন নামাজের মাধ্যমেই মানুষের হিসাব-নিকাশ শুরু হবে। হজরত আনাস (রা.)  থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষের নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। যদি তার নামাজ গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে সমস্ত আমল গ্রহণীয় হবে। আর যদি নামাজ গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে সমস্ত আমলই বাতিল হবে।’ (সিলসিলায়ে সহিহা)

নামাজ ত্যাগকারী ব্যক্তি ইসলামি জীবন থেকে বঞ্চিত এবং তার জীবনযাপন কাফেরের জীবনযাপনের মতোই। কেননা হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ। মুসলিম ব্যক্তি নামাজ আদায় করে আর অমুসলিম ব্যক্তি নামাজ আদায় করে না।

হজরত উবাদা ইবনে সামির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুল (সা.) আমাদের সাতটি অসিয়ত করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ হলো, ‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। যদি তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় বা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয় তাহলেও ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগ করো না। কেননা, যে ইচ্ছা করে নামাজ ছেড়ে দেয় সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমাদ)

হজরত হানজালা উসাইদি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথভাবে আদায় করে, উত্তমরূপে অজু করে, সময়ের প্রতি খেয়াল রাখে, রুকু-সেজদা ঠিকমতো আদায় করে এবং এভাবে নামাজ আদায় নিজের ওপর আল্লাহতায়ালার হক মনে করে, তবে জাহান্নামের আগুন তার জন্য হারাম করে দেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ)

কাজেই পরকালে নাজাত পেতে হলে দুনিয়ার জীবনে নামাজের প্রতি যত্নবান হতে হবে। নামাজি ব্যক্তিরাই জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হবেন। তাই নামাজ আদায়ের প্রতি দৃঢ় হতে হবে এবং একমাত্র মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নামাজ পালনে ব্রতী হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের তওফিক দান করুন। যেন এ নামাজ পরকালে আমাদের মুক্তির অসিলা হতে পারে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত