ইতিহাসের পাতায় এমন এক মহাপুরুষের নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত রয়েছে, যিনি একাধারে ছিলেন খোদাভক্ত, ত্যাগের প্রতীক, ধৈর্যের আদর্শ ও নবীজগতের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম। তাকে বলা হয় মুসলিম জাতির পিতা। হজরত নুহ আলাইহিস সালামের আনুমানিক একাদশ অধস্তন বংশধর তিনি। মহান আল্লাহ তাকে যে উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, তা কেবল তার অতুলনীয় ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফল। ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মহান আল্লাহর পরীক্ষায় পরিপূর্ণ। তিনি সব পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করেছেন ‘খলিলুল্লাহ’ তথা মহান আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে।
ইব্রাহিম (আ.) জন্মেছিলেন এমন এক সমাজে, যেখানে মূর্তিপূজা ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার পিতা আজর নিজেও ছিলেন মূর্তি নির্মাতা। কিন্তু এ পরিবেশও তাকে গোমরাহ করতে পারেনি। শৈশবেই তার হৃদয়ে জেগে ওঠে প্রশ্ন, যাকে মানুষ তৈরি করে, সে কীভাবে তাদের প্রভু হয়? সূর্য-চাঁদের উদয়-অস্ত দেখে, প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতা লক্ষ করে তিনি উপলব্ধি করেন, এই জগতের পেছনে আছেন এক চিরস্থায়ী সত্তা, যিনি অপার শক্তির অধিকারী। তারই সন্ধানেই তিনি নিবেদিত হন।
আগুনে নিক্ষেপ : যখন নবুয়তের দায়িত্ব পেলেন, তখন ইব্রাহিম (আ.) জাতিকে তাওহিদের দিকে আহ্বান করলেন। বোঝাতে চাইলেন মূর্তির অসারতা। কিন্তু তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করল। একবার সুযোগ বুঝে তিনি মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন, তাদের ভুল বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন জালেম রাজা নমরুদের নির্দেশে তাকে নিক্ষেপ করা হয় এক বিশাল অগ্নিকুণ্ডে। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতে সেই আগুন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আগুন! তুমি ইব্রাহিমের জন্য ঠাণ্ডা ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া ৬৯) এ ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতি পরীক্ষা। এতে মহান আল্লাহ তাকে সাহায্যও করেছেন।
নির্জন মরুভূমিতে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে আসা : পরবর্তী সময়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) হিজরত করেন সিরিয়ার কেনান এলাকায়। বার্ধক্যে তিনি লাভ করেন পুত্রসন্তান ইসমাইল (আ.)-কে। তখনই আসে আরেক কঠিন পরীক্ষা। স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে জনমানবহীন মরুর বুকে রেখে আসার নির্দেশ আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। সামান্য পানি ও খাবারসহ তিনি তাদের রেখে আসেন মক্কায়। মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসার সেই দৃষ্টান্ত আজও লাখো হৃদয়কে নত করে। শিশুর পায়ের আঘাতে সৃষ্ট হয় জমজম কূপ, যার পানি আজও বিশ্বের লাখো মানুষকে তৃপ্ত করছে।
পুত্রকে কোরবানির নির্দেশ : ইসমাইল (আ.) যখন একটু বড় হন, তখন ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেন, তাকে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করতে বলা হচ্ছে। তিনি বুঝলেন, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ। কঠিন এই আদেশ পালনে তিনি পুত্রকে প্রস্তুত করেন। দুজনই আত্মসমর্পণ করেন মহান আল্লাহর ইচ্ছার সামনে। যখন কোরবানির জন্য ছুরি চালাতে উদ্যত হন, তখনই মহান আল্লাহ জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন এবং ঘোষণা দেন, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে রূপ দিয়েছ। আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।’ (সুরা সাফফাত ১০৩) হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের জীবন আমাদের জন্য একটি উজ্জ্বল বাতিঘর। যেখানে আছে তাওহিদের অটলতা, পরীক্ষায় ধৈর্য, ত্যাগে মহত্ত্ব এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। যিনি নিজ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, মহান আল্লাহর প্রেমিক হতে হলে কেবল মুখে নয়, হৃদয়, আত্মা ও জীবন সবকিছু দিয়েই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে প্রস্তুত থাকতে হয়।