মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বুদ্ধির গোড়ায় ঢালতে হবে পানি

আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩২ এএম

হাসির রাজা হিসেবে কালোত্তীর্ণ হয়ে আছেন গোপাল ভাঁড়। প্রচলিত আছে, গোপাল ভাঁড় ছিলেন বেশ বেটে এবং স্বাস্থ্যবান। শত্রুর সঙ্গে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লড়াই করা তার দ্বারা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি নাকি বুদ্ধির বলে শত্রুকে হারিয়ে দিতেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেট টেস্টে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে শক্তি কিংবা বুদ্ধি-কোনোটারই ছাপ দেখা গেল না। যেকোনো বিচারেই শক্তিমত্তায় জিম্বাবুয়ে অনেক পিছিয়ে। এমনকি তাদের স্কোয়াডের সম্মিলিত টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতার চেয়ে মুশফিকুর রহিমের অভিজ্ঞতা (৯৪ টেস্ট) বেশি। সেই মুশফিকুর রহিম দুই ইনিংসেই বিলিয়ে দিলেন নিজের উইকেট। কিংবা অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর কথাই ধরুন। চতুর্থ দিন সকালে সবাই যখন জয়ের প্রতীক্ষায়, তখনই তিনি বুঝিয়ে দিলেন, সুন্দর দিনটা অসুন্দর করে তুলতে একটা বাজে শটই যথেষ্ট।

টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ২৫ বছরে একটা দলের প্রধান ব্যাটারদের থেকে আপনি নিশ্চয়ই এমনটা আশা করতে পারেন না। সেই ব্যাখ্যাতীত সব পারফরমেন্সের প্রদর্শনীই দেখা যায় একের পর এক সিরিজে। সমস্যাটা কোথায়? সমস্যার তল খুঁজতে হলে যেতে হবে গভীরে। শূন্য পাইপলাইন ভরিয়ে তোলা তো এত সহজ নয়, বরং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে দ্রুত সমাধান হিসেবে নিজেদের সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটা কাজে লাগানোই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে আলাপচারিতায় শান্তদের জন্য সেই পরামর্শটাই দিলেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার রাজিন সালেহ, ‘আপনি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যদি আমাদের দলকে মেলান, তাদের শারীরিক গঠন আর আমাদের শারীরিক গঠন এক হবে না। ভারতের ক্রিকেটারদের সঙ্গেও আমাদের শারীরিক গঠন মিলবে না। আমার কাছে মনে হয়, আমরা কাউকে অনুকরণ করে ক্রিকেট খেলছি। আমরা নিজেদের মতো একটা দল প্রস্তুত করতে পারিনি। টেস্টের প্রধান বিষয় হলো ধৈর্য। আমাদের মধ্যে ধৈর্যের ঘাটতি ছিল। আমরা বল ছাড়া কিংবা আক্রমণ করা-কোনোটাতেই সফল হইনি। এটা ব্যর্থতাই বলতে হবে। আপনি যখন যুদ্ধ করবেন, তখন কি আপনিই শুধু প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করবেন? তারা আপনাকে আক্রমণ করবে না? এখানেই আমাদের ভুল। এজন্য আগে নিজেদের ডিফেন্স শক্ত করে ঝোপ বুঝে কোপ দিতে হবে। আমরা যুক্তি দেখিয়ে শুধু অ্যাটাকই করে গেছি, কিন্তু ডিফেন্স আমাদের শক্ত ছিল না।’

জিম্বাবুয়ে সিরিজ শুরুর আগে নতুনের ডাক দিয়েছিলেন অধিনায়ক শান্ত। বলেছিলেন, নিজেদের স্টাইলে টেস্ট ক্রিকেটটা খেলার কথা। কিন্তু মাঠের খেলায় নতুন কোনো স্টাইল দেখা যায়নি বটে, দেখা গেছে ব্যর্থতার চিরাচরিত সেই বাংলাদেশি স্টাইল। রাজিন সালেহ যেমন হাসতে হাসতে বললেন, ‘আসলে কোন স্টাইলে খেলেছে আমি জানি না। আমাদের শারীরিক গঠন অনুযায়ী আমাদের খেলা উচিত। আমরা খেলব মাথা দিয়ে, বুদ্ধি খাটিয়ে। চায়নাদের বুদ্ধি কিন্তু অনেক, কিন্তু ওরা গড়নে খাটো। ওরাও তো যুদ্ধ করে, তবে সেটা বুদ্ধি দিয়ে। আমাদেরও এখন থেকে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বুদ্ধি দিয়ে খেলা উচিত। সামর্থ্যরে বাইরে কিছু করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি।’

সর্বশেষ ১০ টেস্টে জয়ের মুখ না দেখা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ দাপটে জিতবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। সিলেটের স্পোর্টিং উইকেটে দু-চারটা সেঞ্চুরিও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু দুই ইনিংস মিলিয়ে নাজমুলের ৬০ রানই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত! ফিফটি মোটে তিনটি। এমন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কেন এত জটিল সমীকরণে যেতে হবে? রাজিন মনে করেন, প্রতিপক্ষকে হালকাভাবে নিয়েছিলেন শান্তরা, ‘এখন বাংলাদেশের টেস্ট দলের যে অবস্থা, তাতে আমরা ভালো অবস্থানে নেই। জিম্বাবুয়ের অবস্থা তো আমাদের থেকেও খারাপ; কিন্তু ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার এত বছর পর সেই দলের কাছেই যদি আমরা ঘরের মাঠে পরিচিত উইকেটে হারি, সেটা দুঃখজনক। আমরা হয়তো ভেবেছিলাম, সবকিছু এমনি এমনি হয়ে যাবে। ব্যাটিং করলে রান হয়ে যাবে, বোলিং করলে উইকেট আসবে। এখানেই হয়তো সমস্যাটা হয়েছে। পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে উন্নতির বিকল্প নেই।’

একটা সময় ছিল, যখন জিম্বাবুয়ে দলে দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার ছিলেন। তখন তাদের কাছে পরাজয়ই ছিল বাংলাদেশের নিয়তি। ধীরে ধীরে শক্তি হারানো সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ২০০৫ সালে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। এখন সেই জিম্বাবুয়েকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা কম হয় না। তবে সিলেট টেস্ট সতর্কবার্তা দেয়, ফর্মে ফেরার জন্য জিম্বাবুয়েকে ডেকে আনার দিনও হয়তো ফুরোতে যাচ্ছে।

‘জিম্বাবুয়েকে এনে যদি ফর্মে ফিরতে চান, তাহলে রান করার ওই অভ্যাসটা আপনার থাকতে হবে। অনুশীলন করতে হবে। আপনি অনুশীলন করছেন কি না, আমি জানি না। কিন্তু এটা তো করতেই হবে। আমার মনে হয়, অনুশীলনেও আমাদের ঘাটতি আছে’, বলছিলেন রাজিন সালেহ। অর্থাৎ শান্তদের সমস্যার শুরু গোড়া থেকেই। একজনের ব্যর্থতায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অন্যজন সুযোগ পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সমস্যার গোড়ায় কেউ নজর দিচ্ছে না।

তৃণমূল থেকে অবিশ্বাস্য ক্রিকেট কাঠামো তৈরি করা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রতি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি হারের পর ক্রিকেটারদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে কিছু কঠোর নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতে ফল এসেছে হাতেনাতে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। তাই বিসিবির নতুন কমিটিও এমন কিছু ভাবতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন রাজিন। তবে তিনি পাইপলাইন ঠিক করে বুদ্ধির গোড়ায় জল দেওয়াতেই গুরুত্ব আরোপ করেছেন, ‘বিশেষ করে বলতে চাই, তৃণমূল থেকে যাতে ক্রিকেটার উঠে আসে, তাদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে। খেলতে হবে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বুদ্ধি দিয়ে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত