বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা শরমিনের যোগদানের পর থেকে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর নিযুক্ত হওয়ার পর বিগত ৭ মাসে উপাচার্যের বিরুদ্ধে একাধিকবার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক সময়ে উপাচার্যের কিছু সিদ্ধান্ত ও আচরণ নিয়ে নতুন করে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। অভিযোগ উঠেছে তিনি একরোখা, স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছে এবং তার প্রশাসনে আওয়ামী দোসরদের পুনর্বাসন করছে। উপাচার্যের এসব বিতর্কিত কর্মকান্ডে দিনদিন অশান্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফ্যাসিবাদবিরোধী মঞ্চের ব্যানারে উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা ও একাডেমিক কার্যক্রমের স্থবিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষার্থী হয়রানি ও অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যর্থতার ২০টি অভিযোগ এনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
এর আগে গত সোমবার থেকে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার এবং তাকে সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলে পুনর্বহালসহ চার দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করলেও তাতে কর্ণপাত করেনি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা। অন্য দাবিগুলো হলো আওয়ামী লীগের পদধারী রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে অবিলম্বে অপসারণ, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের সমর্থক শিক্ষক-কর্মচারীদের অপসারণ এবং একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপাচার্যকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া।
জানা যায়, উপাচার্যের অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় গত ১৩ এপ্রিল একমাত্র অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দীনকে আইন ভেঙে সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে অপসারণ করেছে। এ দিকে রেজিস্ট্রার মনিরুলের ইসলামের যৌন কেলেঙ্কারির ভিডিও নতুন করে ফাঁস হলেও তাকে অবৈধভাবে স্বপদে বহাল রেখেছে উপাচার্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণে যাওয়ার কথা চলতি বছরের গত ১ ফেব্রুয়ারি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা শরমিন নিয়মভেঙে রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে অবসর-উত্তর ছুটি (পিআরএল) থেকে ফিরিয়ে এনে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। অবসর গ্রহণের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে তার পদে বহাল রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ উপাচার্য কোনোভাবে দিতে পারেন না। উপাচার্য অবৈধভাবে রেজিস্ট্রারকে এমনভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন বিধায় সে আদেশ বলে ওই পদে রেজিস্ট্রারের দায়িত্বপালনও অবৈধ বলে জানিয়েছেন একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। এদিকে নিয়মভেঙে আওয়ামী লীগ আমলের স্টাইলে বিজ্ঞাপিত দুটি পিএ টু ভিসি ও পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে।
চব্বিশের গণআন্দোলনে প্রক্টরের দায়িত্বে থাকা কাইয়ুম আন্দোলনকারী এবং আন্দোলন সমর্থনকারী শিক্ষকদের কঠোর হস্তে দমনের ঘোষণা দেন। সরকার পতন হলে প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেও আট মাসের ব্যবধানে ড. কাইয়ুমকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কমিটির অর্থ বণ্টন কমিটির আহ্বায়ক করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা শরমিন।
গত বছরের নভেম্বরের ৩০ তারিখে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানি যোগদান করার ছয় মাস অতিবাহিত হলেও তাকে কোনো কাজ বুঝিয়ে দেয়নি উপাচার্য। এমনকি উপ-উপাচার্যের সঙ্গে বিভাগীয় প্রধান বা শিক্ষকদের কোনো ধরনের সভায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে উপাচার্য। ফলে গত ছয়মাস ধরে কাগুজে উপ-উপাচার্য হয়ে বসে আছেন।
এ প্রতিবেদন করতে গিয়ে ১০-১১ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, ববিতে নানা সংকট রয়েছে। এসব সংকটের দিকে নজর না দিয়ে তিনি (উপাচার্য) আছেন রাজনীতি নিয়ে। জুলাই আন্দোলনের সময় প্রশাসনে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসন নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে তিন কর্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকায় বলি হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ। একইসঙ্গে তারা উপাচার্যের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানীর অভিযোগ, তিনি সব একাডেমিক কাজের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান করবেন। কিন্তু উপাচার্য তাকে বাদ দিয়েই নথিভিত্তিক ও সভাভিত্তিক একাডেমিক সিদ্ধান্ত নেন।
কোষাধ্যক্ষ ড. মামুন অর রশিদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত চেক কোষাধ্যক্ষ এবং তদূর্ধ্ব চেক উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ যৌথ স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু উপাচার্য সব চেকে একাই স্বাক্ষর করেন।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা শরমিন বলেন, ‘ঠগ বাছতে গিয়ে গা উজাড় হয়ে যায়।’ তেমনি এখানে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) যদি আমি বাছাই করতে যাই তাহলে গা উজাড় হয়ে যাবে। আমার বিষয়টি এ রকম যে, কাজটাকে আমার সফলভাবে করতে হবে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই রকমের চিত্র। শিক্ষার্থীরা ক্লাস পরীক্ষায় ফিরুক সেটাই এখন প্রত্যাশা।