বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য জলবায়ু ও দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়ন ও বীমার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এজন্য দরিদ্রবান্ধব, জেন্ডার সংবেদনশীল এবং মানবাধিকারভিত্তিক পদ্ধতি নেওয়ার কথা বলেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগিতায় সোসিও-ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এওএসইডি) কর্তৃক আয়োজিত ‘উপকূলীয় অঞ্চলে দরিদ্র-বান্ধব, জেন্ডার সংবেদনশীল ও মানবাধিকারভিত্তিক সিডিআরএফআই প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা’ শীর্ষক এই আঞ্চলিক গোলটেবিল বৈঠকে এই দাবি করা হয়।
খুলনার ওয়েস্টার্ন ইন হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাস্টিস বাংলাদেশের (সিসিজে-বি) রিসার্চ ফেলো মৌমিতা দাশ গুপ্তা ‘উপকূলীয় অঞ্চলে দরিদ্র-বান্ধব, জেন্ডার সংবেদনশীল ও মানবাধিকারভিত্তিক সিডিআরএফআই স্কোপিং স্টাডি’ শীর্ষক একটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
গবেষণায় জলবায়ু অর্থায়নে ‘বহুমাত্রিক বৈষম্য’ চিহ্নিত করে সমতাভিত্তিক ও স্থানীয়ভাবে প্রবেশযোগ্য অর্থায়ন কাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করেন।
এওএসইডি ও কেয়ার বাংলাদেশের এমএপি সিডিআরএফআই প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত এই গবেষণায় খুলনা বিভাগ, বিশেষ করে বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার শরণখোলা ও তালা উপজেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওইসব উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে পরিবার পর্যায়ের জরিপ, ফোকাস গ্রুপ আলোচনা ও মূল তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ওই গবেষণায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদগুলোর দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়ন পরিচালনার জন্য আর্থিক স্বায়ত্তশাসন, জনবল ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে। এছাড়াও জলবায়ু বীমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা সীমিত। তবে তারা অধিকাংশ অনুদানভিত্তিক সহায়তার চান। এছাড়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে স্থানীয় অর্থায়ন প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা কম জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে।
আলোচনায় এওএসইডির নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফীন বলেন, ‘জলবায়ু-আক্রান্ত দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য রাষ্ট্র একটি বীমা নীতি প্রণয়ন করবে এবং প্রতিশ্রুত ধনী দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত জলবায়ু ক্ষতিপূরণের তহবিল দিয়ে দুর্যোগ বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করে একটি জলবায়ু বীমা স্কিম চালু করবে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র সম্প্রদায়ের উপর কোনো ঋণ বা বীমা প্রিমিয়ামের বোঝা না পড়ে তা নিশ্চিত করতে সতর্ক থাকতে হবে।
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) বিভাগের অধ্যাপক ড তুষার রায় বলেন, ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও হিমালয়ের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে দুর্যোগ অনিবার্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এর সাথে সম্পর্কিত ব্যাঘাত ঘটবেই—এটি এমন এক বাস্তবতা যা আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে, বহু-অংশীদারিত্বভিত্তিক মডেলের মাধ্যমে অভিযোজন কৌশল গ্রহণই এর সমাধান।’
তিনি বলেন, ‘দুর্যোগ ঝুঁকি সমগ্রভাবে মোকাবেলা করতে হবে, যেখানে ফসল, মানবজীবন, মৎস্য ও পশুসম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।’
কেয়ার বাংলাদেশ এর পলাশ মণ্ডল বলেন, ‘দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক অর্থনীতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের বেশিরভাগ ত্রাণ কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হওয়ার পরিবর্তে প্রদর্শন নির্ভর।’
তিনি বলেন, ‘যদি আমরা উদ্ভাবনী আর্থিক ইন্সট্রুমেন্টে বিনিয়োগ করি—যেমন উপযোগী বীমা স্কিম—তবে এটি জলবায়ু-আক্রান্ত সম্প্রদায়ের জীবনে উল্লেখযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি আনতে পারে।’
পলাশ মণ্ডল বলেন, ‘বীমা চাহিদাভিত্তিক হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলীয় মৎস্য খাত বিশেষায়িত বীমা পণ্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। একইভাবে, অন্যান্য খাত ও সম্প্রদায়কে তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী বীমা দেওয়া উচিত। বীমা বাস্তবায়নের ইচ্ছা ও সদিচ্ছা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও নিয়ামক কাঠামো দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।
তিনি বলেন, ‘চলতি গবেষণা ইতোমধ্যে এমন পদ্ধতির সম্ভাব্যতা দেখিয়েছে। এখন আমাদের সক্রিয় সমাধান দরকার। এর মধ্যে সঠিক নিয়ম, কৌশল ও ব্যবসায়িক মডেল উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের বীমা স্কিম প্রয়োজন। পাইলট ও প্রদর্শনী প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষ কে উৎসাহি করতে হবে।’
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মীর রিফাত জাহান উষা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মুস্তাফিজুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুত কুমার সাহা প্রমুখ এই গোলটেবিলে উপস্থিত ছিলেন।