এই ভূখন্ডের জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবেই নিপীড়িত। বারবার জনগণ মুক্তির আশায় জেগে উঠেছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। বর্তমান ইতিহাসে এর প্রমাণ মেলে। ১৯৪৭-এর সংগ্রাম, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এই জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের জ¦লন্ত প্রমাণ। দুঃখ এই যে, প্রতিবারই প্রতি সংগ্রামের দ্বারা কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তোলা যায়নি। হালে ছাত্র-জনতা জুলাই ২৪-এর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে। যার মূল মর্মবাণী বা চার্টারের ঘোষণা ছিল ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদের উত্থানের হিত, ভারতীয় আগ্রাসন উচ্ছেদ ও একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যেখানে ফ্যাসিবাদ চিরতরে বন্ধ হবে। বাংলাদেশের ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী রূপ নেবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ হবে। সুতরাং এমন পরিবর্তিত শাসনব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন হবে অতীতের ক্ষয়ে যাওয়া ভঙ্গুর প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের সংস্কার ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠন। সে স্বপ্ন কতদূর সফল হবে তাই নিয়ে বাংলাদেশ এখন আশা-নিরাশার দোলাচলে। গত ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস অভ্যুত্থান-উত্তরকালে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তার সরকারের কার্যাবলি ও বিভিন্ন বক্তৃতা থেকে আত্মস্থ করা যায় যে, সংস্কার কর্মকান্ড শেষে তিনি একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন। তবে শুরু থেকেই তিনি নির্বাচনের কোনো সম্ভাব্য রোডম্যাপ প্রণয়ন থেকে বিরত রয়েছেন। সংস্কার প্রক্রিয়া বিলম্বিত কিন্তু সংস্কার শেষে একটি প্রতিনিধিত্ব সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কোনো দ্বিমত ছিল না। প্রতীয়মান হয়েছিল সমস্ত রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অংশীদার সম্মিলিতভাবে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার পাশে। সেটা একটি শুভ লক্ষণ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কারণ যে কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এর ফসল ঘরে ওঠানোর জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশীদারদের বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। এখানে বিশেষ করে নেপালের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। যে দেশে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ শেষে নেপালের দলমত নির্বিশেষে যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল, তার বদৌলতে নেপাল আজ একটি এককেন্দ্রিক কর্তৃতবাদী হিন্দুরাষ্ট্র থেকে একটি নারীবান্ধব, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে ২৪ অভ্যুত্থান পরবর্তী জাতীয় ঐক্যকাল অতি ক্ষণস্থায়ী। বেশ কিছু ইস্যুতে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র দ্বারা গঠিত নাগরিক কমিটি পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতবিরোধ লক্ষণীয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে এই তিন প্রধান ক্ষমতা প্রত্যাশিত দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে প্রথমত রয়েছে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হবে কি না, এ নিয়ে মতবিরোধ লক্ষণীয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে এই তিন প্রধান দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।
গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে প্রথমত রয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ হবে কি না, এ নিয়ে মতবিরোধ। এনসিপি মনে করে, বিএনপি আওয়ামী লীগ নিয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে, যেটি ভারতের ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের একটি চক্রান্ত। তাদের যুক্তি অস্বীকার করা যায় না। কারণ যে দলটি নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিকভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের বিচারের আওতায় না এনে, ‘সবকিছু ঠিক আছে’ নীতি (Everything is fine) অবলম্বন জনগণ মেনে নেবে না।
দ্বিতীয়ত, সংস্কার কার্যক্রমের পরিধি ও নির্বাচন। বিএনপির মতে, সংস্কার যেহেতু একটি চলমান প্রক্রিয়া সেহেতু গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়ার তাগাদা দিচ্ছে তারা। ওইদিকে এনসিপির মতে, সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে বিরত থাকা। বিশেষ করে, বিচার বিভাগে ও এর কাঠামোগত সংস্কার দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত। জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান এ ব্যাপারে অস্পষ্ট। ফলে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে দলগুলোর মতবিরোধ বেশ স্পষ্ট, যা দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হতে পারে। এর ফলে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে এনসিপির কিছু কিছু মন্তব্য ও দাবি যেমন নির্বাচন প্রক্রিয়ার আইন সংশোধন, দল নিবন্ধনের শ্রুতিমালা শিথিল করা এবং সর্বোপরি প্রশাসন বিএনপির দ্বারা প্রভাবিত এবং সে জন্য দলটি নির্বাচনে নাও যেতে পারে বিএনপি ও এনসিপিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং জামায়াতে ইসলামী ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করে রাজনৈতিক পরিবেশ আরও ঘোলাটে করে তুলেছে। এমতাবস্থায় নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়ার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের অজুহাত সুদৃঢ় করতে সাহায্য করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মূল কিছু সংস্কার শেষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা এখন ধোঁয়াশা ও অস্পষ্ট, যা দেশের জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়। এই ধোঁয়াশা অবস্থা আরও ঘনীভূত হয়েছে সংবিধান সংস্কারের মতো অতি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে। সংবিধান যে কোনো জাতি ও দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। জনগণ যদি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় বাস করতে চায়, তাদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান থাকতে হবে। যে সংবিধান দেশে সুশাসন, মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবিবেকের চর্চা প্রতিস্থাপন করে দেশের জনগণের জীবন পরিপূর্ণ করে তোলে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে তৈরি করা একটি ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান দেশে নানা বিরোধ ও সমস্যা তৈরি করে। ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধান সেই ইতিহাসের সাক্ষী।
জুলাই ২৪ অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশ ছাত্র-জনতা দাবি তুলেছিল সংবিধান পুনর্লিখনের, যা বর্তমান সংবিধান সংস্কারের সভাপতি ও ঐক্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ এবং বেশ কিছু সুশীল সংবিধান পুনর্লিখনের সুপারিশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সরকার ১৯৭২ সংবিধানের সংস্কারের জন্য ড. আলী রীয়াজকে দিয়ে একটি সুপারিশমালা তৈরি করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমানে এই সুপারিশমালার ওপর মতামত প্রদান করছেন। এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এনসিপি যারা শুরু থেকেই একটি নতুন সংবিধানের দাবি তুলেছিল, তারাও এই আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। তবে আলাচনায় তারা যে দাবি তুলছে, তা থেকে একটি নতুন সংবিধানের রূপরেখা অস্পষ্ট হলেও দৃশ্যমান। যেমন তারা সংবিধানে মূলনীতি রাখার পক্ষে নন এবং রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন চান। যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রোধ করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ রোধের সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে তাহলে তারা কি সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার কথা বলছেন? অবশ্য বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব ও সুশীল বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিহান। তারা মনে করেন, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবে এ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। বরঞ্চ রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার সুস্পষ্ট ক্ষমতা বিভাজন ও একটি শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক নির্বাহী তৈরি করা প্রয়োজন। যা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত।
যাই হোক, এনসিপির পক্ষে ১৯৭২ সালের সংবিধানের সংস্কার-সুপারিশমালায় অংশগ্রহণ করা এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তনের দাবি এদের স্ববিরোধিতা বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়া ১৯৭২-এর সংবিধান সংস্কারের দ্বারাই একটি কার্যকর সংবিধান তৈরি করা সম্ভব, তবে তাদের গণপরিষদের দাবিও অযৌক্তিক। কারণ গণপরিষদের প্রধান কাজই হলো সংবিধান রচনা করা। এতদ্বিধ নানা কারণে দেশে আদৌ নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে গুঞ্জন দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সদ্য প্রকাশিত নারী উন্নয়নের সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন, যা দেশের ইসলামপন্থি দলগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ কার্যকলাপে অংশ নিতে বিরত রাখতে পারে। যে দেশে এখন জাতীয় ঐকমত্যে প্রয়োজন অতি আবশ্যকীয় যে দেশ বহুধা বিভক্ত ও বিভাজনে জর্জরিত সেখানে নতুন করে বিভাজন উসকে দেওয়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে কতটা সহায়ক হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো দেশের এই সংকটে। রোহিঙ্গা সমস্যা দূরীকরণের নামে আমেরিকার ২০২১ সালের বার্মা অ্যাক্ট-এর প্রস্তাবিত মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা প্রদান করার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করার যে গুঞ্জন উঠেছে, তাতেও দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভ্যুত্থান উত্তর যে কোনো দেশে সংকট উত্তরণের জন্য যে জাতীয় দৃঢ় ও লৌহকঠিন ঐকমত্যের প্রয়োজন সেটির অনুপস্থিতিতে দেশ কবে ও কেমন করে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করতে পারবে, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রফেসর ড. ইউনূসের সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ করার যে প্রচার শুরু হয়েছে, তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অশুভ। কারণ এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিনিধিত্ব সরকার ছাড়া কোনো দেশ স্থিতিশীল হতে পারে না। এ ছাড়া বাংলাদেশকে ঘিরে পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে ভারত-চীন ও আমেরিকার উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি যা ভঙ্গুর বাংলাদেশকে আরও ভঙ্গুর করে দিতে পারে। তার জন্য দরকার একটি শক্তিশালী ও জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বারবার বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা আমাদের হতাশ করেছেন। তবু রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি বোঝেন ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পারেন। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকটের জন্য শুধু রাজনীতিবিদরাই দায়ী নন দেশের সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ এরা কি দায় এড়াতে পারে?
পরিশেষে এ কথা অনস্বীকার্য যে, উপরোক্ত যে পরিস্থিতি তাতে আশঙ্কা জাগে তবে কি জুলাই ২৪-এর অভ্যুত্থানে শত শত তরুণের আত্মাহুতি ও হাজার হাজার আহতের আর্তনাদে ভরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কি অধরাই রয়ে যাবে দেশের রাজনৈতিক দল, সুশীল ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের ঐকমত্যের অভাবে? বাংলাদেশ কি তাহলে ঘরে এবং বাইরে অবরুদ্ধ?
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক